ঢাকা, বুধবার, ৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫,
সময়: ১০:০৭:৪৯ PM

ক্যাম্পাসে ক্যাম্পাসে সংঘাত,উদ্বিগ্ন’ সরকার

ষ্টাফ রিপোটার।। দৈনিক সমবাংলা
03-09-2025 01:40:11 PM
ক্যাম্পাসে ক্যাম্পাসে সংঘাত,উদ্বিগ্ন’ সরকার

জাতীয় নির্বাচন, সংস্কারসহ নানান ইস্যুতে রাজনৈতিক অঙ্গনে উত্তাপের মধ্যেই অস্থিতিশীল হয়ে উঠেছে দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। চট্টগ্রাম, রাজশাহী, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে একই দিনে অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়ে। ভিন্ন ভিন্ন কারণে সংঘর্ষ-হতাহতের ঘটনায় উদ্বিগ্ন সরকারও।খোঁজ নিয়ে জানা যায়, কোথাও ছাত্র সংসদ নির্বাচন নিয়ে মুখোমুখি অবস্থানে ছাত্র সংগঠনগুলো, কোথাও দাবি-দাওয়া নিয়ে আন্দোলনে নামা শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার ঘটনায় দেখা দিয়েছে অস্থিরতা। ঘটনার জেরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের মতো সিদ্ধান্তও নিতে হয়েছে কর্তৃপক্ষকে।শিক্ষাঙ্গনের এ অস্থিরতা নিরসনে আপাতদৃষ্টিতে বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষাপ্রশাসন ‘ব্যর্থ’। কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তো অসহায়ত্বের কথা প্রকাশ্যে স্বীকার করেছেন। শিক্ষাবিদরা বলছেন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও শিক্ষা প্রশাসনে যারা দায়িত্ব পালন করছেন, তাদের অনেকে অনভিজ্ঞ। ফলে কোনো ঘটনা ঘটলে তাৎক্ষণিক তা সমাধান করতে পারছেন না। ছোট ছোট ঘটনা বড় আকার ধারণ করছে। এতে রাজনৈতিক উসকানিও রয়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে চলমান উত্তপ্ত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য তা ‘অশনিসংকেত’ হতে পারে।অন্যদিকে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অস্থিতিশীলতা কাটিয়ে শিক্ষার পরিবেশ ফেরাতে সমাধানের পথ খুঁজছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এক্ষেত্রে মন্ত্রণালয় বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) কাঁধে ভর করেছে। ইউজিসির কাছে প্রস্তাব চেয়েছে। সে আলোকে দীর্ঘমেয়াদে ক্যাম্পাসে স্থিতিশীলতা ফেরাতে কাজ করবে সরকার।

স্থানীয়দের সঙ্গে চবি শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষ
গত ৩০ আগস্ট রাতে এক ছাত্রীকে হয়রানির জেরে স্থানীয় জোবরা গ্রামের বাসিন্দাদের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়। পরদিন দুপুরে আবারও গ্রামবাসীর সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ান শিক্ষার্থীরা। শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, রক্তক্ষয়ী এ সংঘর্ষ উসকে দেন বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের নেতারা। আর গ্রামবাসীর সঙ্গে হামলায় অংশ নেন নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগ ও কার্যক্রম স্থগিত থাকা আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা।চবি শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, গ্রামবাসীর সঙ্গে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা শিক্ষার্থীদের ওপর দফায় দফায় হামলা চালালেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের সহযোগিতা পাওয়া যায়নি। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কর্মকর্তারা শিক্ষার্থীদের উদ্ধারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের সহযোগিতা চাইলেও তাতে তাৎক্ষণিক সাড়া মেলেনি। ফলে সংঘর্ষ দীর্ঘ হয়েছে। আহতের সংখ্যাও বেড়েছে। এতে দুই শতাধিক শিক্ষক-শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন।বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক মো. কামাল উদ্দিন বলেন, ‘আমরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে যে ধরনের সহযোগিতা চেয়েছি, তা পাইনি। যদি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা আমাদের আহ্বানে সাড়া দিতেন, তাহলে এতসংখ্যক শিক্ষার্থী হতাহত হতো না। শিক্ষকরাও আহত হতেন না।’অধ্যাপক মো. কামাল উদ্দিন বলেন, ‘ঘটনার পর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ও আশপাশের এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে। তিন স্তরের নিরাপত্তা বাহিনী রয়েছে। সেনাবাহিনীর অন্তত ১০ প্লাটুন সৈন্য মোতায়েন রয়েছে। আমরা তদন্ত কমিটি করেছি। তদন্তে যা উঠে আসবে, সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
বাকৃবিতে শিক্ষার্থীদের ওপর স্থানীয়দের হামলা
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) পশুপালন ও ভেটেরিনারি সায়েন্স একসঙ্গে করে কম্বাইন্ড ডিগ্রির জন্য বিএসসি ইন ভেটেরিনারি সায়েন্স ও অ্যানিমেল হাজবেন্ড্রি কোর্স চালু দাবিতে দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন চালিয়ে আসছেন অনুষদটির শিক্ষার্থীরা। গত ৩১ আগস্ট এ দাবিতে বাকৃবি উপাচার্যসহ দুই শতাধিক শিক্ষককে অবরুদ্ধ করে রাখেন তারা।রাতে হঠাৎ বহিরাগতরা সেখানে হামলা চালালে শিক্ষার্থীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যান। এরপর উপাচার্যসহ শিক্ষকরা সেখান থেকে বেরিয়ে যান। এ ঘটনায় বাকৃবি অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয় এবং শিক্ষার্থীদের হল ছাড়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়। তবে শিক্ষার্থীদের অনেকে এখনো হলে অবস্থান করছেন। এ নিয়ে ক্যাম্পাসে উত্তপ্ত পরিস্থিতি বিরাজ করছে।সবশেষ খবর অনুযায়ী, শিক্ষার্থীরা রেললাইন অবরোধ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ভবনে তালা ঝুলিয়ে ক্যাম্পাসে অবস্থান নিয়েছেন। তারা ৩১ আগস্ট রাতে শিক্ষার্থীদের ওপর বহিরাগতদের হামলার ঘটনায় প্রক্টরিয়াল বডির পদত্যাগসহ ছয় দফা দাবিতে আন্দোলনে চালিয়ে যাচ্ছেন। অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি এড়াতে ক্যাম্পাস এলাকায় পুলিশের পাশাপাশি বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে।

বাকৃবির প্রক্টর অধ্যাপক আবদুল আলীম  বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের সব দাবি মেনে নেওয়ার পর কেন, কী কারণে তারা উপাচার্যসহ শিক্ষকদের অবরুদ্ধ করে রেখেছিল, তা আমার কাছে স্পষ্ট নয়। তাদের কোনো পক্ষ উসকানি দিয়েছে নাকি তারা ভুল বুঝে এটা করেছে, তা তদন্ত করে দেখা হবে।’

বহিরাগতরা ক্যাম্পাসে প্রবেশ করে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালানোর অভিযোগ প্রসঙ্গে বাকৃবি প্রক্টর বলেন, ‘আমি অবরুদ্ধ ছিলাম। কারা এসে হামলা চালিয়েছে, তা জানি না। তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্য অনুষদের শিক্ষার্থী নাকি বহিরাগত তা তদন্ত করে দেখতে হবে।’
ডাকসু ঘিরে ঢাবিতে ক্ষণে ক্ষণে উত্তেজনা
ডাকসু নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর আগে থেকে ঢাবিতে ছাত্রদল, শিবির ও বাম সংগঠনগুলোর মধ্যে বাদানুবাদ চলছিল। তফসিলের পর তা ক্রমেই বাড়ছে। নানান ঘটনাপ্রবাহে ক্ষণে ক্ষণে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কল্যাণে তাতে মুহূর্তেই জড়িয়ে পড়ছেন দেশ-বিদেশে অবস্থানরত ফেসবুক ব্যবহারকারীরা।মত-দ্বিমত, অশ্রাব্য ভাষায় প্রতিপক্ষকে গালিগালাজ, নারীদের নিয়ে কুরুচিপূর্ণ মন্তব্যসহ নানা ইস্যুতে উত্তপ্ত সারাদেশ। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ডাকসু নির্বাচনে প্রায় ৪০ হাজার ভোটার। তবে ৯ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া এ নির্বাচন আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের অ্যাসিড টেস্ট হিসেবে দেখছেন অনেক বিশ্লেষকরা।
ডাকসুর সাবেক ভিপি, প্রবীণ রাজনীতিক মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, ‘ডাকসু ঘিরে উন্মাদনা সব সময় থাকে। তবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কারণে এবার তাতে ভিন্নমাত্রা দেখছি আমরা। উত্তেজনা চলুক, প্রচার-প্রচারণা চলুক। দিনশেষে রক্তপাতহীন সুষ্ঠু ভোট হওয়াটা জরুরি। সেদিকে প্রশাসনকে নজর রাখতে হবে। একেবারে শেষ মুহূর্ত। পক্ষপাতিত্বমূলক কোনো কার্যক্রম প্রশাসনের পক্ষ থেকে হলে নির্বাচন ভন্ডুল হতে পারে। প্রশাসনকে সতর্ক ও নিরপেক্ষ থাকতে হবে। বাকিটা ছাত্র সংগঠনগুলোর সহনশীলতার ওপর নির্ভর করবে।’

রাকসু ঘিরে মুখোমুখি ছাত্রদল-ছাত্রশিবির
প্রায় ৩৪ বছর পর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ নির্বাচন (রাকসু) আয়োজন করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। তবে তফসিল ঘোষণার পরও দফায় দফায় রাকসু নির্বাচন নিয়ে জটিলতা দেখা দিয়েছে। নির্বাচন নিয়ে ছাত্রদল ও ছাত্রশিবিরের মুখোমুখি অবস্থানের কারণে ক্যাম্পাসটিতে ব্যাপক উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছে।

জানা যায়, প্রথম দফায় ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী, আগামী ১৫ সেপ্টেম্বর রাকসু নির্বাচন হওয়ার কথা ছিল। তবে দফায় দফায় তফসিলে পরির্বতন আনা হয়েছে। এ পর্যন্ত ছয়বার রাকসুর তফিসিল পরিবর্তন হয়েছে।

সবশেষ গত ৩১ আগস্ট রাকসুর কোষাধ্যক্ষের কার্যালয়ে প্রবেশ করে চেয়ার-টেবিল ভাঙচুর করে মনোনয়নপত্র বিতরণ বন্ধ করে দেন ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক সমন্বয়ক সালাহউদ্দিন আম্মারের নেতৃত্বে শিক্ষার্থীরা এর প্রতিবাদ করেন। পরে সেখানে মনোনয়নপত্র নিতে যান ছাত্রশিবিরের নেতাকর্মীরা। এসময় ছাত্রদল ও ছাত্রশিবিরের নেতাকর্মীরা মুখোমুখি অবস্থান নিয়ে স্লোগান দেন। এতে ক্যাম্পাসে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। এ ঘটনায় বেশ কয়েকজন আহত হন।বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের সভাপতি সুলতান আহমেদ রাহী  বলেন, ‘আমরা প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের ভোটার করার দাবি জানাচ্ছি। এটা অত্যন্ত যৌক্তিক দাবি। তাছাড়া একটি সংগঠনকে প্রশাসন যে সুবিধা ও প্রশ্রয় দিচ্ছে, তার প্রতিবাদ করেছি। সেখানে শিবির এসে হামলা করেছে। এতে আমাদের অনেকে আহত হয়েছে। ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা চরম ধৈর্যের পরিচয় দিয়েছে। আগামীতে আমরা শিক্ষার্থীদের নিয়ে তাদের মোকাবিলা করবো।’

রাবির প্রক্টর অধ্যাপক ড. মো. মাহবুবর রহমান বলেন, ‘নির্বাচন কমিশন রাকসু আয়োজনে কাজ করছে। বিভিন্ন পক্ষের দাবিগুলো তারা পর্যালোচনা করছে এবং যৌক্তিক হলে তা পূরণও করার পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। প্রশাসন ক্যাম্পাসের সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় রাখতে কাজ করছে। আমরা ছাত্র সংগঠনগুলোর কাছ থেকে দায়িত্বশীল আচরণ প্রত্যাশা করছি। তাহলে ক্যাম্পাস ও শিক্ষার্থীরা নিরাপদ থাকবে।’
বিএসসি ও ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের দ্বন্দ্ব
চাকরির ক্ষেত্রে সুযোগ দেওয়া, না দেওয়া নিয়ে বিএসসি ইঞ্জিনিয়ার ও ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারদের মধ্যে দ্বন্দ্ব চলছে। এতে বুয়েট, রুয়েট, চুয়েট, কুয়েটসহ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কার্যত অচল। তারা ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন কর্মসূচি করছেন। একই সঙ্গে বিভাগীয় সমাবেশ করার ঘোষণা দিয়েছেন।

ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারদের পক্ষ থেকেও নিয়মিত বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করা হচ্ছে। ঢাকা, গাজীপুর, রংপুরসহ দেশের বিভিন্ন জেলার পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে এ নিয়ে সংকট তৈরি হয়েছে। ফলে প্রায় চার লাখ পলিটেকনিক শিক্ষার্থীও ক্লাসরুম ছেড়ে মাঠে নেমেছেন।
সংকটে আরও কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়
সিরাজগঞ্জের রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা স্থায়ী ক্যাম্পাস নির্মাণের দাবিতে টানা আন্দোলন করছেন। একই দাবি নিয়ে আন্দোলনে নেমেছেন কিশোরগঞ্জ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও। অবকাঠামো নির্মাণসহ নানা দাবিতে প্রায়ই রাস্তায় নামছেন বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও। দাবি আদায়ে তারা ঢাকা-কুয়াকাটা মহাসড়ক অনির্দিষ্টকালের জন্য অবরোধের হুঁশিয়ারি দিয়েছেন।

ছাত্র সংসদের দাবিতে উত্তপ্ত জবি-ইবি-হাবিপ্রবি
দেশের তিনটি বিশ্ববিদালয়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচনে সরগরম। অথচ বাকি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নির্বাচন আয়োজনের কোনো পদক্ষেপ নেই। এমনকি ৪৬টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে এ নিয়ে কোনো আইনই নেই। ফলে সেখানে ছাত্র সংসদ চালুর দাবিতে আন্দোলনে নেমেছেন শিক্ষার্থীরা। জগন্নাথ, ইসলামী, বরিশাল, বেগম রোকেয়া, হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ চালুর বিধি প্রণয়নের দাবিতে শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করছেন। এতে ওই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও ক্লাস-পরীক্ষা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।

পাঠ নয় মাঠে শিক্ষার্থীরা, বাড়বে সেশনজট
২০২৪ সালের জুন মাস থেকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ক্লাস-পরীক্ষা বন্ধ হয়ে যায়। প্রথমে সর্বজনীন পেনশন স্কিমের বিরোধিতা করে শিক্ষকরা আন্দোলনে নামেন। আর কোটা সংস্কারের দাবিতে জুলাইয়ের শুরু থেকে মাঠে নেমে পড়েন শিক্ষার্থীরা। এরপর ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থান। অভ্যুত্থান-পরবর্তীসময়ে ক্যাম্পাসগুলোর চিত্র পাল্টে যায়।

আওয়ামী লীগপন্থি শিক্ষকদের পদত্যাগ, ছাত্রলীগ ধরিয়ে দেওয়া, রাজনীতির বিরোধিতাসহ নানা কারণে উত্তপ্ত ছিল ক্যাম্পাস। এতে ২০২৪ সালের বাকি ছয়মাস তেমন ক্লাস হয়নি। অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে শর্টকাট কোর্স করিয়ে পরীক্ষা নেওয়া হয়েছে। চলতি বছরের শুরু থেকেও নানান কারণে ব্যাহত হয়েছে ক্লাস। অভ্যুত্থানের পর এক বছর ক্লাসে পাঠের চেয়ে মাঠেই বেশি সময় কেটেছে শিক্ষার্থীদের। এতে সেশনজট বাড়বে বলে মনে করছেন শিক্ষাবিদরা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. কামরুল হাসান মামুন। তিনি ঢাবির সিনেটে সরকার মনোনীত শিক্ষাবিদ সদস্য। তার মতে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সমস্যা ও সংকটের মূল কারণ যোগ্য শিক্ষক ও প্রশাসকের অভাব।

অধ্যাপক কামরুল হাসান মামুন বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখন রাজনৈতিক খেলার মাঠে পরিণত হয়েছে। সবাই সারাক্ষণ শুধু রাজনৈতিক ফায়দা লুটতে ব্যস্ত। ডাকসু নির্বাচন এখন পুরো দেশজুড়ে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। এ নির্বাচনে শুধু একটি বা দুটি প্যানেল সম্ভবত লেজুড়বৃত্তিক রাজনীতির বাইরে। বাকিরা সবাই জাতীয় নির্বাচনের প্রি-টেস্ট খেলছে।’

সমাধানের পথ খুঁজছে সরকার, দায়িত্ব ইউজিসির কাঁধে
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অস্থিতিশীলতা কাটাতে সমাধানের পথ খুঁজছে সরকার। শিক্ষা মন্ত্রণালয় এ নিয়ে করণীয় ঠিক করতে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের কাঁধে ভর করেছে। ১ সেপ্টেম্বর মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে ইউজিসিকে চিঠি দিয়েছে। তাতে উল্লেখ করা হয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের যথাযথ শিক্ষার পরিবেশ নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে বিদ্যমান সমস্যা চিহ্নিত করতে হবে। প্রয়োজনীয়তা যাচাইপূর্বক সুনির্দিষ্ট কার্যক্রমের প্রস্তাব পাঠানোর জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হলো।

জানতে চাইলে শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. চৌধুরী রফিকুল (সিআর) আবরার বলেন, ‘কয়েকদিন ধরে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যে অস্থিতিশীলতা বিরাজ করছে, তা নিয়ে আমরা উদ্বিগ্ন। এ নিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় কাজ করছে। সংকটগুলো নিরসনের পথে আমরা অনেকটা দূর এগিয়েছি। আশা করছি, শিগগির সমাধান হয়ে যাবে।’

তিনি বলেন, ‘ইউজিসিকে আমরা নির্দেশনা দিয়েছি, তারা যেহেতু বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে নানা পরামর্শ দেয়, সেজন্য তাদের কাছ থেকে আমরা প্রস্তাবনা চেয়েছি। কী কী করলে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার পরিবেশ নিশ্চিত করা যাবে, রক্তপাত বন্ধ হবে, তা নিয়ে তারা সুপ্রস্তাব দেবেন। আমরা সেগুলো বাস্তবায়নের মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদে সমাধানের পথে হাঁটতে চাই।’মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা পেলেও এখনো বিষয়টি নিয়ে আনুষ্ঠানিক কাজ শুরু করেনি ইউজিসি। সংস্থাটির চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এস এম এ ফায়েজ বলেন, ‘শিক্ষা মন্ত্রণালয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে দীর্ঘমেয়াদে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ ফেরাতে চায়। ইউজিসি এ নিয়ে মন্ত্রণালয়ে কিছু প্রস্তাবনা পাঠাবে। প্রস্তাব তৈরির ক্ষেত্রে আমরা অবশ্যই শিক্ষার্থীদের চাওয়াকে গুরুত্ব দেবো। তারা কী চায়, কীভাবে চায় সেটাতে নজর দেওয়া হবে। একই সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনে কী আছে, শিক্ষকরা কেমন ভূমিকা পালন করতে পারেন- সেগুলো তুলে এনে একটি পূর্ণাঙ্গ প্রস্তাব মন্ত্রণালয়ে পাঠাবো আমরা।’
বিশ্ববিদ্যালয়ে অস্থিরতার প্রভাব পড়তে পারে জাতীয় নির্বাচনেও
আগামী ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে জাতীয় নির্বাচন দিয়ে বিদায় নিতে চায় অন্তর্র্বতী সরকার। নির্বাচন কমিশনও জাতীয় নির্বাচনের রোডম্যাপ প্রকাশ করেছে। তবে রাজনৈতিক দলগুলোর চরম মতপার্থক্যে ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচন হবে কি না, তা নিয়ে ধোঁয়াশা রয়ে গেছে। রাজনৈতিক অঙ্গনে এমন উত্তাপের মধ্যেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অস্থিরতা দেখা দিলে তার প্রভাব জাতীয় রাজনীতিতেও পড়বে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।

ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. মনজুর আহমদ বলেন, ‘জুলাইয়ে গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে দেশের রাজনীতিতে ছাত্রদের প্রভাব ও অবস্থান যে কোনো সময়ের তুলনায় এখন বেশি। সেই ছাত্ররা যদি কোনোভাবেই সংঘাত-সহিংসতায় জড়িয়ে যায়, তাহলে জাতীয় নির্বাচন ঝুঁকির মধ্যে পড়বে। ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে দীর্ঘমেয়াদে এমন অস্থিরতা দেশ ও জাতির জন্য মঙ্গলজনক নয়।’একই অভিমত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীরও। তিনি বলেন, ‘শিক্ষাঙ্গন উত্তপ্ত হলে সব সময় তা জাতীয় রাজনীতিকে প্রভাবিত করে। এবার পরিবেশ ভিন্ন। সেক্ষেত্রে আরও গভীর সংকট তৈরি হতে পারে। সমাধানের উপায় তো একটাই; শিক্ষার্থীদের গণতান্ত্রিক অধিকার ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে।’