
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমদ বলেছেন, জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে পিআর পদ্ধতিতে ভোট হবে নাকি আনুপাতিক হারে আসন বণ্টন হবে—তার জন্য কেউ জীবন দেয়নি। তারা চেয়েছে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা। আর গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার একটাই মাত্র পথ হলো নির্বাচন। এখন যারা ক্ষমতার মোহনায় পড়ে গেছেন, তারা শুধু ঘুরিয়ে-পাঁচিয়ে কথা বলছেন। সহজ পথ হলো তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন। একটা সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে আমাদের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সাধারণ জনগণ এলাকায় নেতা হিসেবে তাকেই চান, যাকে তারা চেনেন, সব সময় পাশে পাবেন। কিন্তু শুধু মার্কা দিয়ে তাকে কীভাবে চিনবেন? পিআর পদ্ধতিতে দেখা যাবে, ভোলায় যে সংসদ সদস্য হবেন, তার বাড়ি কুড়িগ্রামে।
শনিবার (২ আগস্ট) রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে (আইইবি) জুলাই গণঅভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তিতে শহীদ পরিবারের প্রতি সম্মাননা অনুষ্ঠানে তিনি এসব কথা বলেন। অনুষ্ঠানের আয়োজন করে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন বাংলাদেশ (আইইবি) ঢাকা কেন্দ্র।
মেজর হাফিজ বলেন, আজ একজন শহীদ পিতা বলেছেন, জুলাই গণঅভ্যুত্থানে শহীদরা যে স্বপ্ন নিয়ে জীবন দিয়েছেন, আজও তা অর্জিত হয়নি। এটা অত্যন্ত বেদনাদায়ক কথা। আমি মনে করি, এর কারণ হলো—বর্তমানে যে সরকার আছে, তারা কেউই জুলাই চেতনাকে ধারণ করেন না। বিগত ১৫ বছরে উপদেষ্টাদের কেউ শেখ হাসিনার দুঃশাসনের বিরুদ্ধে একটি কথাও বলেননি। এমনকি প্রধান উপদেষ্টাও শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে কিছু বলেননি। শুধু উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল মাঝে মাঝে দুই-একটি কথা বলেছেন।
তিনি বলেন, দীর্ঘদিন আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে স্বৈরাচার শেখ হাসিনাকে পরাজিত করেছি। বিপ্লবে যারা জীবন দেন, বিপ্লবের পর তাদের মূল্যায়ন করা হয় না। অনেক লোক কোথা থেকে গজায়, আন্দোলন-সংগ্রামের সব কৃতিত্ব নিয়ে নেয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ছিল ৮১ হাজারের মতো, আর এখন তা দাঁড়িয়েছে আড়াই লাখ। এর কৃতিত্ব আওয়ামী লীগের। তারা যখনই ক্ষমতায় এসেছে, তখনই আত্মীয়-স্বজনসহ সবাইকে মুক্তিযোদ্ধা বানিয়েছে।
হাফিজ আহমদ বলেন, জাতীয় ঐকমত্যে কমিশনের সংলাপে বিএনপি একদিকে, আর অন্যদিকে ৩৪ দল। বিএনপির জনসমর্থন কত আর ৩৪ দলের জনসমর্থন কত—এটা দেখা হোক। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত ৭২-এর সংবিধানকে তারা ছুঁড়ে ফেলে দিতে চায়। একটি রাজনৈতিক দল যারা ’৭১-এ মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল, তারা এখন বলে তারা ভুল করেছে। এসব কথা বলার সুযোগ কোথা থেকে পেল? মুক্তিযুদ্ধে আমি আহত হয়েছিলাম—এসব কথা অত্যন্ত কষ্ট দেয়। আমাদের দেশে বিশাল সাহসী তরুণ সমাজ আছে, যা বিশ্বের অন্য কোনো দেশে নেই। এই তরুণ সমাজ দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার দায়িত্ব পালন করবে।
ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির আহ্বায়ক আমিনুল হক বলেন, “জুলাই আন্দোলনের স্ফুলিঙ্গ একদিনে তৈরি হয়নি। গত ১৭ বছরের বিএনপির আন্দোলনের মধ্য দিয়েই এটি গড়ে উঠেছে। এই আন্দোলনে আমাদের বহু নেতা-কর্মী নিহত ও আহত হয়েছেন।”
তিনি বলেন, “আজকে জুলাই গণঅভ্যুত্থানকে একটি গোষ্ঠী নিজেদের করে নেওয়ার চেষ্টা করছে। এটা দুর্ভাগ্যজনক। একটি মহল বিচার ও সংস্কারের নামে নির্বাচন পিছিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে। ক্ষমতার লোভে পড়ে নতুন দল (এনসিপি) শহীদ পরিবারকে ব্যবহার করার চেষ্টা করছে। জুলাই শহীদ এবং ফ্যাসিস্টদের দোসরদের আমরা বিচার করতে চাই। আগামী দিনে বিএনপি নির্বাচনে জয়লাভ করলে শহীদ পরিবারকে রাষ্ট্রীয় খেতাব ও মর্যাদা দেওয়া হবে।”
বিএনপির নির্বাহী কমিটির বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক সহসম্পাদক আশরাফ উদ্দিন বকুল বলেন, ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা একদিকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিক্রি করেছেন, অন্যদিকে উন্নয়নের নামে বড় প্রকল্পের আড়ালে লুটপাট চালিয়েছেন। ঠিক তেমনি, বর্তমানে কথায় কথায় ‘জুলাই বিপ্লব’কে সামনে রেখে ‘সংস্কার’-এর নামে ‘জাতীয় নাগরিক পার্টি’ (এনসিপি) গোপনে চাঁদাবাজি চালাচ্ছে। আপনারা মূল স্রোত থেকে সরে গেছেন। সঠিক পথে ফিরে আসুন। আমরা শহীদদের পাশে থাকব, আপনাদের বদনামের ভাগীদার হব না।
সাভারে শহীদ আসাদুল ইয়ামিনের বাবা মো. মহিউদ্দিন বলেন, “আমার সন্তান নিহত হয়েছে পুলিশের গুলিতে। কিন্তু এখন পর্যন্ত আমরা বিচারের কোনো দৃশ্যমান অগ্রগতি দেখতে পাচ্ছি না। যে বাহিনী সরাসরি হত্যার সঙ্গে জড়িত, তারা কিভাবে তদন্ত করবে? বিগত এক বছরে কেন একজন পুলিশ সদস্যও বরখাস্ত বা গ্রেপ্তার করা হয়নি? সংস্কারের নামে আমাদের প্রহসনের কথা শোনানো হচ্ছে। আমাদের দেশের সমকামিতাকে বৈধতা দেওয়ার জন্য সন্তানরা জীবন দেয়নি।”
শহীদ রবিউল ইসলাম লিমনের চাচা মোল্লা আহমেদ সাইদ টুলু বলেন, “মা-বাবা বোঝেন সন্তান হারানোর বেদনা। গত এক বছরে জুলাই হত্যাকাণ্ডের বিচার কতটা দৃশ্যমান হয়েছে? আদৌ আমরা বিচার পাব কি না, তা নিয়েও সন্দেহ রয়েছে।”
তিনি বলেন, “আওয়ামী দোসররা এখনো অন্তর্র্বতী সরকারকে উৎখাতের নানা ষড়যন্ত্র করছে। তাদের মধ্যে কোনো অনুশোচনা নেই। সম্প্রতি আর্মির একজন মেজরের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের গেরিলা প্রশিক্ষণের খবর গণমাধ্যমে এসেছে। সামনে আওয়ামী লীগ মাথাচাড়া দিয়ে উঠলে আরও অনেককে শহীদ হতে হবে। গত এক বছরে প্রশাসনসহ বিভিন্ন জায়গায় স্বৈরাচারের দোসরদের কেন চিহ্নিত করা গেল না? তাদের চিহ্নিত করে শাস্তির আওতায় আনতে হবে।”
আইইবি ঢাকা কেন্দ্রের সভাপতি প্রকৌশলী মো. হেলাল উদ্দিন তালুকদারের সভাপতিত্বে আরও বক্তব্য রাখেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ডা. এজেএম জাহিদ হোসেন, ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির আহ্বায়ক আমিনুল হক, বিএনপির বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক সহসম্পাদক প্রকৌশলী আশরাফ উদ্দিন বকুল, নির্বাহী কমিটির সদস্য প্রকৌশলী আব্দুস সোহবান, এ্যাবের সাবেক মহাসচিব আলমগীর হাসিন আহমেদ, আইইবি সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ড. সাব্বির মোস্তফা খান, আইইবি ঢাকা কেন্দ্রের সদস্য প্রকৌশলী লোকমান প্রমুখ।
অনুষ্ঠানে শহীদ ওয়াসিম আকরাম, শহীদ আসাদুল ইয়ামিন, শহীদ রবিউল ইসলাম লিমন, শহীদ রাব্বি মিয়া, শহীদ রাকিব হোসাইন, শহীদ আহনাফ আবির, শহীদ অয়ন এবং শহীদ রুদ্রর পরিবারকে সম্মাননা প্রদান করা হয়।
অনুষ্ঠানে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের শহীদ ও আহতদের স্মরণে এবং জিয়ার পরিবারের জন্য কোরআন তেলাওয়াত ও দোয়া পরিচালনা করেন আইইবি ঢাকা কেন্দ্রের সদস্য প্রকৌশলী মাহবুবুল আলম। অনুষ্ঠানে বিগত ১৫ বছর ধরে গুম-খুন, জুলুম-নির্যাতন এবং জুলাই গণঅভ্যুত্থান নিয়ে একটি ভিডিও ডকুমেন্টারি প্রদর্শন করা হয়।