ঢাকা, শুক্রবার, ১১ জুলাই ২০২৫,
সময়: ১১:২৪:৪৯ PM

গণঅভ্যুত্থান প্রত্যাশার তুলনায় প্রাপ্তি কম

ষ্টাফ রিপোটার।। দৈনিক সমবাংলা
11-07-2025 12:00:23 PM
গণঅভ্যুত্থান প্রত্যাশার তুলনায় প্রাপ্তি কম

স্বৈরাচার শেখ হাসিনার পতন ঘটানো ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের বছরপূর্তি হচ্ছে এই জুলাইয়ে। শত শত প্রাণ আর অসংখ্য মানুষের আত্মত্যাগের সাক্ষী এই অভ্যুত্থান ঘিরে তৈরি হয় এক ধরনের গণআকাঙ্ক্ষা।বছর পেরিয়ে সেই আকাঙ্ক্ষা কতদূর বাস্তবায়িত হলো, তা নিয়ে চলছে নানা বিশ্লেষণ। অনেকে বলছেন, যে বৈষম্য দূর করার লক্ষ্যে অভ্যুত্থান হয়েছে, তা এখনো রয়ে গেছে রাষ্ট্রে-সমাজে। এছাড়া অভ্যুত্থান দমনে পতিত ফ্যাসিবাদী সরকার যে গণহত্যা চালিয়েছিল, তার বিচারেরও দৃশ্যমান অগ্রগতি হয়নি। গত বছরের জুলাই মাসে ক্যাম্পাসে ক্যাম্পাসে শুরু হয় কোটা সংস্কার আন্দোলন। সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে গড়ে তোলা ওই আন্দোলন দমনে ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগের সরকার হত্যা-নির্যাতন-গণগ্রেপ্তার শুরু করলে তা রূপ নেয় বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে। ওঠে স্বৈরাচার শেখ হাসিনার সরকারের পতনের এক দফা দাবি। সেই দাবিতে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে। তাতে যোগ দেয় সব শ্রেণি-পেশার মানুষ।
 
দীর্ঘ এক মাসের আন্দোলন আর হাজার মানুষের রক্তের বিনিময়ে ‘৩৬ জুলাই’ খ্যাত ৫ আগস্ট পতন ঘটে দেশের বুকে জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসা ফ্যাসিস্ট সরকারের। শত শত শহীদের রক্তের বিনিময়ে বিজয় অর্জন করে ছাত্র-জনতা। এতে এই জনপদে যেন স্বস্তি ফিরে আসে। পাল্টে যায় দেশের রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশ, বদলে যায় জনমানুষের প্রত্যাশা। তৈরি হয় গণআকাঙ্ক্ষা।

এই আকাঙ্ক্ষা থেকে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে প্রধান উপদেষ্টা করে অন্তর্র্বতী সরকার গঠন করা হয়। জনদাবি আর রাজনৈতিক দলগুলোর সমর্থনে এই সরকার জুলাই গণহত্যার বিচার, বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কারসহ নানা উদ্যোগ নেয়। কিন্তু প্রায় বছর পার হতে চললেও গণহত্যার বিচারের অগ্রগতি নিয়ে প্রশ্ন থেকেই গেছে। এছাড়া এখনো ‘জুলাই সনদ’ পায়নি জনতা, বিভিন্ন খাতের সংস্কারও পায়নি দৃশ্যমান বাস্তবতা।
 
ফলে অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী ছাত্র-জনতা, বিশিষ্টজন, রাজনৈতিক নেতাসহ সংশ্লিষ্টদের মনে প্রশ্ন জেগেছে, যে বৈষম্য দূরীকরণে এতো মানুষ শহীদ হলেন, আহত হলেন, দৃষ্টি হারালেন, পঙ্গুত্ব বরণ করলেন—সেই কাঙ্ক্ষিত বৈষম্যহীন বাংলাদেশের যাত্রা কতদূর? ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ, ’৯০-এর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের মতো ’২৪-এর গণঅভ্যুত্থানের লক্ষ্যও কি বিচ্যুত হবে? নাকি ছাত্র-জনতার রক্তের বিনিময়ে অর্জিত বিজয় বৈষম্যহীন নতুন বাংলাদেশের পথে যাত্রা করবে?
 
সংশ্লিষ্ট মহলের কেউ কেউ কিছুটা হতাশা ব্যক্ত করে বলছেন, ফ্যাসিস্ট সরকারের পতনের মধ্য দিয়ে ছাত্র জনতার আন্দোলনের প্রাথমিক সফলতা অর্জিত হয়। তবে আন্দোলন পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন সংস্কার, বৈষম্য নিরসনের পথে যাত্রার পথ এখনো সুগম হয়নি, সেই লক্ষণও দেখা যাচ্ছে না। ফলে ২০২৪-এর গণঅভ্যুত্থানের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির দোলাচলে ভুগছে দেশের মানুষ।  

‘জুলাই বিপ্লবকেও এখনো স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি’
যে আকাঙ্ক্ষা এবং স্বপ্ন নিয়ে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন, এক বছরের পর তার কতটুকু বাস্তবায়ন দেখছেন জানতে চাইলে আহত জুলাইযোদ্ধা ওবায়দুল হক বাংলানিউজকে বলেন, ‘কই, কিছুই দেখতে পাচ্ছি না। জুলাই সনদ এখনও ঘোষণা দেওয়া হয়নি। আমরা এতো মানুষ পঙ্গু হলাম, রক্ত দিলাম, দুই হাজারের মতো ভাই-বোন শহীদ হলেন, কিন্তু জুলাই ঘোষণাটাই দেওয়া হচ্ছে না। ’

তিনি জুলাই অভ্যুত্থানের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি চেয়ে বলেন, ‘পরবর্তীতে যদি কোনো সরকার আসে, তারা বলবে তোমার পুলিশ মারছো, আমাদের নামে মামলাও হতে পারে। আমরা দেশের জন্য সব করেছি, দেশ আমাদের কী দিল?’

অভ্যুত্থানে আহত আরেক জুলাইযোদ্ধা শাহীনুর রহমান শাহীন বলেন, ‘আমরা যে চেতনা নিয়ে জুলাই আন্দোলনে করেছিলাম, তার প্রথম উদ্দেশ্য ছিল বৈষম্য দূর করা, মানুষের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করা। আমরা সবাই মিলেমিশে জুলাই আন্দোলন করেছিলাম একটা অপশক্তির বিরুদ্ধে। আন্দোলনের সময় সবাই একসঙ্গে লড়াই করলেও পরবর্তীতে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল নিজেদের দলীয় স্বার্থে জুলাইয়ের মূল উদ্দেশ্য থেকে দূরে সরে আসে। ’
 
তিনি আরও বলেন, ‘আন্দোলনের আগে কেউ মুক্তমনে কথা বলতে পারতো না, জুলাই আন্দোলনের পর সবাই মনের ক্ষোভ প্রকাশ বা কথা বলতে পারছি। জুলাই আন্দোলনের পর এইটুকু সফলতা হয়েছে। এছাড়া যে মূল লক্ষ্য ছিল সমাজের বৈষম্য দূর করা, সেটা আমরা করতে পারিনি। সবার জন্য আইন সমান, সেটাও করতে পারিনি। বাকস্বাধীনতা ছাড়া একটাও পূরণ হয়নি। এমনকি জুলাই বিপ্লবকেও এখনো স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। ’

আগে শুধু আওয়ামী লীগ এবং তার অঙ্গ সংগঠনসমূহ সব কিছু ভোগ দখল করতো, এখন সেই জায়গায় ক্ষমতার হাতবদল হয়ে অন্যান্য দল সেগুলো করেছে উল্লেখ করে শাহীনুর রহমান বলেন, ‘সাধারণ জনগণ সেই সময়েও নিপীড়িত ছিল এবং এখনো নিপীড়িত-বঞ্চিত রয়েছে। ’

‘খুব অগ্রগতি হয়নি, কিছু পরিবর্তন হয়েছে’
ডাকসুর সাবেক ভিপি ও গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর বাংলানিউজকে বলেন, ‘সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের যে যৌক্তিক এবং ন্যায্য ছাত্র আন্দোলন ছিল, সেটা শেষ পর্যন্ত রাষ্ট্র এবং সমাজ বদলের আন্দোলনে পরিণত হয়। সেই কারণেই সব শ্রেণি-পেশার মানুষ এই আন্দোলনে সম্পৃক্ত হয়েছে। যেই রেজিমের বিরুদ্ধে আমরা আন্দোলন করেছি, তার পতন ঘটেছে, এটা আমাদের প্রাথমিক সফলতা। এই রেজিমের পতনের পরে মানুষের যে আকাঙ্ক্ষা নতুন একটা রাষ্ট্রব্যবস্থা, সেখানে আমরা হয়তো খুব বেশি অগ্রগতি দেখতে পাইনি। তবে কিছু পরিবর্তন হয়েছে, সেটাও স্বীকার করতে হবে। ’

তিনি আরও বলেন, ‘আর্থিক খাতের শৃঙ্খলা ফিরেছে। যদিও কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়নি, কিছুটা উন্নতি হয়েছে। প্রতিকূল একটা পরিবেশের মধ্যেও দ্রব্যমূল্য মানুষের নাগালের মধ্যে ছিল। এগুলো ইতিবাচক বিষয়। আবার মানুষের মধ্যে হতাশা এবং ক্ষোভও আছে, বিশেষ করে এই সরকারের ১০ মাস পরেও বিভিন্ন ধরনের সঙ্ঘবদ্ধ মব সৃষ্টি হচ্ছে। ’

এই তরুণ রাজনীতিবিদ বলেন, ‘আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির কিছুটা অবনতি ঘটছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় উন্নতি হয়নি। মানুষের জানমালের নিরাপত্তার জন্য আমাদের একটা শক্তিশালী আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দরকার। সেই জায়গায় আমরা পিছিয়ে আছি। জুলাই সনদও ঘোষণা করা হয়নি। আমরা আশা করছি জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের আলাপ-আলোচনার মধ্যে দিয়ে আমরা সেদিকে যেতে পারবো। এসব বিষয় যদি আরও দৃশ্যমান হয়, তাহলে আমরা বলতে পারবো, এই গণঅভ্যুত্থানের যে জনআকাঙ্ক্ষা, সেখানে আমরা অনেক দূর এগিয়ে যেতে পারছি। ’

‘যে চেতনার ভিত্তিতে অভ্যুত্থান, বাস্তবে সরকার উল্টোদিকে হাঁটছে’
এ বিষয়ে বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বাংলানিউজকে বলেন, ‘গোটা আন্দোলনটাই ছিল একটা বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন। কিন্তু বাস্তবে আমরা গত এক বছরে বৈষম্য বিলোপের কার্যকর কোনো উদ্যোগ আমরা দেখিনি। অন্তর্র্বতী সরকার ১১টা কমিশন গঠন করেছে। কিন্তু বৈষম্য বিলোপের জন্য এখনো কোনো কমিশন হয়নি। আমি প্রধান উপদেষ্টাসহ আরও অনেকের কাছে এটা জোরালোভাবে বলেছি, কিন্তু তারা এটাকে আমলে নেননি। ’

তিনি আরও বলেন, ‘গত এক বছরে বৈষম্য আরও বেড়েছে। ৩০ থেকে ৩৫ লক্ষ মানুষ নতুন করে দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে এসেছে। কর্মহীন মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। বিনিয়োগ বাড়ছে না। এর মধ্যে শ্রেণি-বৈষম্য, ধনী-গরিবের বৈষম্য অনেক বেশি বাড়ছে। আমরা অভ্যুত্থান করেছি যে চেতনার ভিত্তিতে, বাস্তবে সরকার মনে হচ্ছে উল্টোদিকে হাঁটছে। বৈষম্য কমার পরিবর্তে বৈষম্য বাড়ছে। ’
 
তিনি বলেন, ‘আমরা বিভিন্ন সংস্কারের জন্য ঐকমত্য কমিশনে নানা আলোচনা করছি, এগুলো সব রাজনৈতিক সংস্কার। আসল বৈষম্য অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে। যখন আমরা বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের বছরপূর্তি করছি, তখন কেবল দীর্ঘশ্বাস দেখছি। অভ্যুত্থানের পরে ক্ষমতা একটা দুর্বৃত্ত লুটেরা শ্রেণির কাছ থেকে একই শ্রেণির তুলনামূলক উদার গণতান্ত্রিক—তাদের মধ্যে হাতবদল হয়েছে। কিন্তু আসলে মৌলিক কোনো শ্রেণির হাতে ক্ষমতার হাতবদল হয়নি, যেজন্য বৈষম্যের কোনো বিলোপ হয়নি। এটা আমাদের বড় একটা হতাশার জায়গা। বৈষম্যের বিলোপ না হলে রাজনৈতিক সংস্কার টেকসই হবে না। ’

গণতন্ত্রে উত্তরণের নির্বাচন এখনো হয়নি
গণঅভ্যুত্থানের বছরপূর্তিতে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু বাংলানিউজকে বলেন, ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের প্রায় এক বছর হতে চললো, সেই আন্দোলনে আমরা স্বৈরতন্ত্রের পতন দেখেছি। স্বৈরতন্ত্রের পতনের পরে স্বাভাবিক নিয়মেই সবাই গণতন্ত্রের প্রত্যাশা করেছিল। গণতন্ত্রে উত্তরণের জন্যে একটা সাধারণ নির্বাচনের প্রয়োজন ছিল, সেই আয়োজন (প্রধান উপদেষ্টা) ড. ইউনূস করবেন সেটাই মানুষ প্রত্যাশা করেছিল। এখনো আমরা সেই নির্বাচন পাইনি। এই না পাওয়ার কারণে অনেক কথা আমরা শুনছি-দেখছি, যেটা জুন থেকে এপ্রিল, এপ্রিল থেকে ফেব্রুয়ারি, এখন যেটা প্রত্যাশা করছি, তখন এক বছর পেরিয়ে গিয়েছি। ’

বিএনপির এ ভাইস চেয়ারম্যান আরও বলেন, ‘গণতন্ত্র এবং স্বৈরতন্ত্রের যে পার্থক্য সেখানে আমরা ঢুকেছি বটে, তবে এখন পর্যন্ত আশার মধ্যে আমরা আছি। ছাত্রদের হলের সমস্যা, শিক্ষার সমস্যা, আইন-শৃঙ্খলার সমস্যা, অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধান হয়েছে বলে আমার কাছে মনে হয়নি। তবে উদ্যোগ আছে, ভবিষ্যতে হয়তো হবে। সেই আশা নিয়েই দেশের মানুষ অপেক্ষা করছে। ’

‘অপরাধীদের বিচার দৃশ্যমান হয়নি’
জুলাই অভ্যুত্থানের এক বছর পর দেশের পরিস্থিতি কেমন দেখছেন জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক কাজী মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘গত ১৫ বছরের কর্তৃত্ববাদী শাসনের প্রেক্ষাপটে মানুষের মাঝে যে প্রত্যাশা তৈরি হয়েছিল, তার অনেক ক্ষেত্রেই জনগণ হতাশ। ১৫ বছর মানুষ ভোট দিতে পারেনি। তাদের মধ্যে ভোট দেওয়ার আকাঙ্ক্ষা আছে, তবে সেই আকাঙ্ক্ষা এখনো দৃশ্যমান নয়। মানুষ আশা করেছিল, যারা বড় অপরাধী, যাদের কারণে গুম-খুন হয়েছে, অন্তত তাদের বিচার দৃশ্যমান হবে। সেটিও হয়নি। ’

বৈষম্য নিরসনে মানুষের প্রত্যাশা কতটা পূরণ হচ্ছে, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এবারের আন্দোলনের পর মানুষের প্রত্যাশা ছিল ১৯৯০ সালের চেয়েও বেশি। এবার তরুণরা ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল। সবার আশা ছিল একটি জবাবদিহিমূলক সরকার আসবে। তারা ভেবেছিল, সুষ্ঠু নির্বাচনের কাঠামো তৈরি হবে। তরুণরা ভেবেছিল সংস্কারের মাধ্যমে একটি নতুন বাংলাদেশ পাবে। কিন্তু সেই প্রত্যাশা আজ কোথায়?’