পর্ব – ৭
কলির রাতগুলো যেন দিনের চেয়েও অন্ধকার। রুমের দরজা বন্ধ করলেই তাকে তাড়া করে বেড়ায় ভাঙা স্বপ্নগুলো, নীলের ফুঠে ওঠা হাসি, আর সুমার সঙ্গে কাটানো মুহূর্তগুলো। মোবাইলের স্ক্রিনে নীলের নম্বরটা জ্বলজ্বল করে—
হয়তো কল করতে পারেৃ
হয়তো একবার জানতে চাইবে, কেমন আছে সেৃ
কিন্তু না, কিছুই হয় না। স্ক্রিন জ্বলে, আবার নিভে যায়।
বাড়ির সবাই বুঝতে পারে, কলির ভেতরে কিছু একটা বদলে গেছে। মা বারবার কথা বলতে আসে, কিন্তু কলি শুধু মাথা নাড়ে। বাবা দূর থেকে তাকিয়ে থাকে—মেয়েটাকে এভাবে ভেঙে পড়তে দেখে মনটা কেমন করে ওঠে তার। কিন্তু কলি কাউকে কোনো ব্যাখ্যা দেয় না। ব্যথাটা সে নিজের ভেতরেই গুমরে রাখে।
রাতের অন্ধকারে একসময় মোবাইলটা পাশে রেখে বিছানায় শোয়া কলি নিজের চোখ দুটো শক্ত করে বন্ধ করে।
নিজেকে বারবার বলে—
"না, এভাবে ভেঙে পড়া যাবে না। আমাকে বাঁচতেই হবেৃ আমাকে করতে হবে কিছু একটা।"
পরদিন খুব ভোরে সে উঠে পড়ে। জানলার পর্দা সরাতেই সকালের আলো তার ক্লান্ত চোখে পড়ে। দিনের শুরুটা যেন তাকে একটু সাহস যোগায়।
বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হতে হতে কলি প্রথমবারের মতো আয়নায় নিজের দিকে তাকায়।
চোখ দুটো লাল, কিন্তু ভেতরে কোথাও যেন নতুন করে জেদ জমছে।
“নীল যদি ভুলে যেতে পারেৃ আমি কেন থেমে যাব?”
ক্যাম্পাসে পৌঁছে কলি আগের মতো নীরব থাকলেও আজ তার হাঁটায় এক ধরনের দৃঢ়তা রয়েছে। ক্লাসে সে মনোযোগ দিয়ে বসে, নোট নেয়, প্রশ্ন করে। তার সহপাঠীরা অবাক হয়ে দেখে—কলি যেন নিজের ভেতর নতুন করে জন্ম নিচ্ছে।
এদিকে নীলও ক্যাম্পাসে আসে, তবে কলিকে মনেই হয় না। সুমার সঙ্গে হাসি-ঠাট্টা করতে করতে সে নিজের জগতে ব্যস্ত। কলিকে দেখলেও যেন দেখেনি।
কিন্তু কলি এবার আর চোখ ফিরিয়ে নেয় না—
সে একবার তাকায়, তারপর আবার নিজের পড়ায় মন দেয়।
দুপুরে লাইব্রেরিতে বসে কলি চুপচাপ পড়ছে। বইয়ের পাতা উল্টাতে উল্টাতে সে বুঝতে পারে—ব্যথাটা কমছে না, কিন্তু তাকে শক্ত করছে।
ঠিক তখনই এক সিনিয়র আপু এসে পাশে বসে।
“কলি, আজ অনেক মনোযোগী দেখাচ্ছে তোমাকে। ভালো লাগলো।”
কলি একটু হেসে বলে,
“হ্যাঁ আপু, এবার মনে হচ্ছে সত্যিই সামনে তাকাতে হবে। পিছনে নয়।”
সিনিয়র আপু মমতার সঙ্গে তার পিঠে হাত রাখে।
“ঠিক তাই। জীবন কারও জন্য থেমে থাকে না, কলি। নিজের জন্যই বাঁচতে শিখতে হয়।”
সেদিন বিকেলে ক্যাম্পাস ছাড়ার সময় কলির মনে হয়,
এই প্রথম দিন— সে ভেঙে না পড়ে দাঁড়াতে পারছে।
আর ফিরে যাওয়ার পথে আকাশের দিকে তাকিয়ে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে—
"আমি ভাঙবো না। আমাকে বড় হতে হবে। প্রমাণ করতে হবেৃ আমি হারিনি।"
চলবেৃ
উপন্যাস: নিঃশব্দ ছায়া
পর্ব – ৮
বিশ্ববিদ্যালয়ে সেদিনের ঘটনার পর কলির ভেতরে অদ্ভুত এক শক্তি জন্ম নেয়। ব্যথা আছে, অভিমান আছে—কিন্তু তার চেয়ে বড় হয়ে উঠছে নিজের প্রতি বিশ্বাস। নিজের গায়ে জমে থাকা দুঃখের ধুলো ঝেড়ে ফেলতে সে ধীরে ধীরে শিখছে।
পরদিন ঠিক সময়েই ক্লাসে যায়। সবার ভিড়ে কলির মুখে আগের মতো নিশ্চুপতা থাকলেও চোখে আছে স্থিরতা। আজ স্যার ক্লাসে হঠাৎ একটা গ্রুপ প্রেজেন্টেশনের ঘোষণা দিলেন। ক্লাসে ছোটখাটো হইচই শুরু হলো। কলি একটু দোনামোনা করছিল—এখনও সবার সামনে দাঁড়ানোর মতো মানসিক শক্তি কি তার আছে?
ঠিক তখনই তন্বী এসে বলল,
“কলি, আমাদের গ্রুপে তুই থাক। তোকে ছাড়া কাজ জমবে না।”
কলি কিছুক্ষণ চুপ থেকে মাথা নেড়ে রাজি হলো।
নিজেকে সামনের দিকে ঠেলে না দিলে আর এগোনো যাবে না—কথাটা সে বুঝে গেছে।
অন্যদিকেৃ
নীল আর সুমা হাত ধরে ক্যাফেটেরিয়ায় ঢুকল। অনেকে তাকালেও ওরা যেন নিজেদের আলাদা জগতে। সুমা হাসছে, নীলও মজা করছে।
হঠাৎ নীলের চোখের কোণ দিয়ে কলিকে দেখতে পেল—সে বন্ধুদের সঙ্গে শান্তভাবে বসে প্রেজেন্টেশনের আলোচনা করছে।
নীল একটু থমকে গেল।
কলিৃ
যে মেয়েটা একসময় একটু কথা না বললেই উদাস হয়ে যেত, আজ যেন নিজেকে নতুন করে দাঁড় করাচ্ছে।
কিন্তু নীল কিছু বলল না।
না এগিয়ে গেল, না ফিরে তাকাল।
অদ্ভুত এক অস্বস্তি তার বুকের ভেতর খচখচ করতে থাকল।
প্রেজেন্টেশনের প্রস্তুতি
লাইব্রেরিতে গ্রুপের সবাই জড়ো হলো। তন্বী বিষয় বুঝিয়ে দিলে কলি নিজের অংশটা নিয়ে খুব মনোযোগ দিয়ে কাজ করতে শুরু করে।
কয়েকবার তন্বী ওকে দেখে বিস্মিত হলো—
“বাহ রে কলি, তুই তো একেবারে সিরিয়াস! অনেকদিন পর তোকে এমন দেখছি।”
কলি শুধু মাথা নেড়ে হাসল।
তার ভেতরে যে একসময় ঝড় বইছিল, এখন সেখানে ধীরে ধীরে তৈরি হচ্ছে শক্ত একটা ভিত্তি।
সন্ধ্যায়ৃ
বাড়ি ফেরার পথে বাসের জানালার বাইরে তাকিয়ে কলির মনে হলো—আজকের দিনটা অন্যরকম।
ভালো লাগা, কষ্ট, জেদ—সবকিছু মিলেমিশে তার ভেতরে নতুন একটা আত্মবিশ্বাস তৈরি হচ্ছে।
বাড়ি ফিরে মা জিজ্ঞেস করল,
“আজ যেন তোমাকে বেশ ভালো দেখাচ্ছে! কোনো সমস্যা নেই তো?”
কলি প্রথমবার হাসিমুখে বলল,
“না মা, সব ঠিক আছেৃ আজ বরং খুব ভালো একটা দিন গেছে।”
মা বিস্মিত হয়ে মেয়ের দিকে তাকিয়ে থাকে।
এই হাসিটা অনেকদিন বাড়িতে দেখা যায়নি।
অন্যদিকে, নীলের হলরুমেৃ
রাতে বিছানায় শুয়ে নীলের মাথায় বারবার ভেসে উঠছে কলির আজকের দৃঢ় চাহনি।
কেন যেন অস্বস্তি ছাড়ছে না তাকে।
সুমার সঙ্গে এতক্ষণ সময় কাটিয়ে এলেও মনটা যেন কোথাও আটকে গেছে—
কলির সেই চুপচাপ, শক্ত হয়ে ওঠা চোখের কাছে।
নিজের অজান্তেই নীলের বুকের ভেতর প্রশ্ন উঠল—
“আমি কি সত্যিই ভুলে গেছি তাকে? নাকি ইচ্ছা করেই চোখ ফিরিয়ে রেখেছি?”
কিন্তু উত্তর খুঁজে পায় না নীল।
সেদিন রাতের আকাশে যেন দু’জন দুইভাবে জেগে থাকে—
একজন নতুন করে পথে নামার জন্য,
আরেকজন নিজের অনুভূতির পরিচয় খুঁজতে খুঁজতে।
চলবেৃ
উপন্যাস: নিঃশব্দ ছায়া
পর্ব – ৯
সকালের আকাশটা আজ কিছুটা মেঘলা। কলি বিশ্ববিদ্যালয়ের গেটে ঢুকতেই হালকা বাতাস তার চুলগুলো এলোমেলো করে দেয়। কোনোদিন হাওয়ার স্পর্শ তার কাছে এমন স্বস্তি এনে দেয়নি—আজ যেন আবার বাঁচার ইচ্ছে শক্ত হয়ে ফিরে আসছে।
আজ তাদের গ্রুপ প্রেজেন্টেশনের দিন। সবাই আগেভাগে ক্লাসরুমে এসে প্রস্তুতি নিচ্ছে। কলির বুকের ভেতর হালকা ধুকপুকানি—এটা ভয় নয়, বরং উত্তেজনা।
“আমি পারবৃ আজ আমাকে নিজের জন্য জয়ী হতেই হবে।”
তন্বী কলির পাশে এসে বলল,
“দেখ, কোনো টেনশন নিবি না। তুই তো দারুণ প্রস্তুত।”
কলি মাথা নেড়ে হাসল।
হ্যাঁ, প্রস্তুত তো আছিইৃ তবে সবচেয়ে প্রস্তুত হয়েছি নিজেকে বদলানোর জন্য।
ক্লাসের ভেতর
শিক্ষক আসতেই প্রেজেন্টেশন শুরু হলো। গ্রুপের দু’জন আগে বলল, এরপর কলির পালা।
ক্লাসরুমে গুঞ্জন থেমে গেল।
অনেকেই কলিকে এত আত্মবিশ্বাস নিয়ে দাঁড়াতে দেখে অবাক।
কলি ধীরে ধীরে সামনে এগিয়ে এল।
মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে এক মুহূর্তের জন্য চোখ বন্ধ করল।
গভীর শ্বাস নিল।
তারপর যখন কথা বলা শুরু করল—
সবাই স্তব্ধ।
স্পষ্ট, স্থির, আত্মবিশ্বাসী কণ্ঠে তথ্য উপস্থাপন করে যাচ্ছে।
একবারও থমকাল না, কাঁপল না।
ক্লাসের পেছনে বসে নীল সব দেখছে।
তার চোখে একধরনের বিস্ময়।
এটা কি সেই কলি?
যে একটু আঘাতে ভেঙে পড়ত?
নীলের বুকের ভেতর কেমন জানি একটা চাপ ধরে—
যেন কেউ বলে উঠছে,
“তুই ভুল করেছিসৃ খুব বড় ভুল।”
প্রেজেন্টেশন শেষে
ক্লাসে হাততালির শব্দ উঠল।
স্যারও প্রশংসা করে বললেন,
“কলি, তোমার অংশটা ছিল সবচেয়ে শক্তিশালী। খুব ভালো!”
কলি নিচু স্বরে বলল,
“থ্যাংক ইউ স্যার।”
তার চোখে সেই মুহূর্তে গর্ব—নিজের জন্য, নিজের লড়াইয়ের জন্য।
বন্ধুরা ঘিরে ধরল তাকে।
তন্বী তো বলে উঠল,
“ওই নীল দেখল তোকে? আজ তোকে দেখে ওর চোখের ভাষা বদলে গেছে!”
কলি তন্বীর দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসল।
“দেখলে দেখুকৃ আমার জীবনে আর ওর কোনো ভূমিকা নেই।
নিজের জীবনে আমি নিজেই যথেষ্ট।”
কথাটা বলার সঙ্গে সঙ্গে তার বুকটা হালকা হয়ে যায়—
যেন এক বোঝা নামল।
অন্যদিকে নীলৃ
ক্লাস শেষ হতেই সবাই বেরিয়ে যায়।
নীল দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকে, যেন কলিকে একটা কথা বলবে।
কিন্তু কলি নিজের বন্ধুদের সঙ্গে হাসতে হাসতে বেরিয়ে যায়।
তার চোখে একবারও ওঠে না নীল।
অবহেলা নয়—
এটা ছিল মুক্তি।
নীল চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে।
প্রথমবার তার মনে হয়, কলিকে সে সত্যিই হারিয়েছে।
আর সেটা তার নিজের কারণে।
দূরে দাঁড়িয়ে নীলের চোখে হালকা ঝাপসা ভাব—
পশ্চাৎপট থেকে কলির হাসির শব্দ ভেসে আসে,
আর নীল ভিতর থেকে ছাইয়ের মতো নীরব হয়ে যায়।
বিকেলের ক্যাম্পাস
কলি লাইব্রেরি থেকে বের হয়ে সবুজ মাঠে দাঁড়িয়ে থাকে।
নরম রোদ আর হাওয়া মিলেমিশে তার ক্লান্ত মনকে শান্ত করে দেয়।
আজকের দিনটা তার জীবনের মোড় ঘোরানোর দিন—
সে তা অনুভব করতে পারে।
মনে মনে বলে—
“যা হারিয়েছি, তা ছিল কষ্ট।
যা পেয়েছি, তা হলো নিজের প্রতি বিশ্বাস।”
সে হাসে।
একটা মুক্ত, শান্ত, সাহসী হাসি।
চলবেৃ