ঢাকা, শনিবার, ৬ ডিসেম্বর ২০২৫,
সময়: ১১:০৯:৫১ PM

ঢাকার ফুটপাথে শীতের রাত

ষ্টাফ রিপোটার।। দৈনিক সমবাংলা
06-12-2025 09:52:15 PM
ঢাকার ফুটপাথে শীতের রাত

 ঢাকার শীত খুব দীর্ঘ নয়, কিন্তু যখন আসে, তখন ফুটপাতে থাকা অসহায় মানুষের শরীরে তার কামড় গভীরভাবে লাগে। আনুষ্ঠানিক আবহাওয়ার হিসেবে তাপমাত্রা খুব কম নয়, কিন্তু যারা শহরের ব্যস্ত নগরজীবনের ভিড়ে নিজের জীবন-জীবিকা চালানোর জন্য ফুটপাতে থাকা মানুষদের জন্য তা এক ভয়ঙ্কর বাস্তবতা। রাত ঘন হলে দোকানের শাটার নামলে, যানবাহনের শব্দ কমে এলে ফুটপাথে উদ্ভূত হয় এক ভিন্ন ঢাকা; যেখানে শীতের কাঁপুনি ও অনিশ্চয়তা মানুষের জীবনকেই হুমকি দেয়। মগবাজারের ফ্লাইওভারের নিচে মজিবুর রহমান নামের একজন পুরোনো কম্বলে গা মোড়া শুয়ে আছেন। কম্বলের মধ্যে বেরিয়ে থাকা হাত দুটো দেখলেই বোঝা যায়, তার শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা আর ঠান্ডার শক্তির মধ্যে লড়াই চলছে। তিনি বলেন, “দিনে যা পাই, রাতে তা দিয়েই চলতে হয়। শীতে সমস্যা আরও বেড়ে যায়। কম্বল কিনতে গেলে ৪০০–৫০০ টাকা লাগে, টাকা কোথা থেকে পাব?”

পথশিশু রিমন (১২) বলেন, “আমি রাতে কারও দোকানের সামনে ঘুমাই। শীতে কষ্ট অনেক বেশি। অনেকেই পুরনো কাপড় দেয়, তখন হয়তো আমাদের ভাগে পড়ে। রাতে যখন সবাই ঘুমায়, তখন ভয় লাগে—ঠান্ডা না হলে অন্য মানুষের ভয়। তারপরও ঘুমাই, কী করবো? সকালে কাজ করতে হয়—বাজারে ব্যাগ টানি। শীতের রাতে মনে হয় আমার মতো বাচ্চাদের কেউ দেখে না।”

শহরের বিভিন্ন মোড়ে শীতের সঙ্গে লড়াই করে এমন মানুষের গল্প আছে, আবার আছে নিঃশব্দ চোখের পানি। বাড্ডা, মহাখালী, সদরঘাট, কমলাপুর রেলস্টেশনের ফুটপাথে মানুষ নিজেদের গুটিয়ে নেন ছোট্ট এক আশ্রয়ে। যাদের মাথার ওপর ছাদ নেই, তাদের রাতগুলো অনিশ্চয়তা ও ভয়ে ভরা।

নীলক্ষেতের আয়ুব আলী (৬০) বলেন, “তিন বছর ধরে এখানে আছি। আগে একটা দোকানে কাজ করতাম। শরীর খারাপ হওয়ার পর আর কাজ পাইনি। রাতে ঠান্ডায় ঘুম আসে না, আবার জ্বরও আসে।” তিনি একটি পুরোনো কাঁথা গায়ে মোড়েন, কিন্তু শীত তো কাঁথা দিয়ে চলে যায় না। শ্বাস-প্রশ্বাসের মাঝে মাঝে যেন জমে থাকা বরফের স্পর্শ লেগে থাকে।

শিশুরাও শীতের প্রভাবে অসুস্থ হয়। ঠান্ডাজনিত রোগ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। ফুটপাথের মানুষদের কাছে পর্যাপ্ত শীতবস্ত্র বা নিরাপদ আশ্রয় নেই, এমনকি ছোটখাটো ওষুধের ব্যবস্থা থাকাও ব্যতিক্রম। ফলাফল হিসেবে অনেকেই জ্বর, কাশি বা নিউমোনিয়ার ঝুঁকিতে থাকে। আজিমপুর কবরস্থানের পাশে এক মা বলেন, “আমার বাচ্চা দুই দিন ধরে ঠান্ডায় শীত-শীত করছে। জ্বরও এসেছে। কিন্তু ওষুধ কিনবো কীভাবে? খাবারের টাকাও ঠিকমতো হয় না।”

ঢাকার রাতের দৃশ্য বাইরে থেকে যতই আলোকিত হোক, ফুটপাথের মানুষের কাছে সেই আলো দূরের বিল্ডিংয়ের জানালায় ঝুলে থাকা একরাশ ধোঁয়া মাত্র। তারা দেখে উষ্ণ পোশাকে মানুষ, রেস্তোরাঁর সামনে গাড়ি থামছে, কেউ ফোনে হাসছে, আর তারা নিজেরা ঠান্ডা ভেজা বাতাস, পুরনো কাঁথা, ভাঙা ফুটপাত আর সকাল না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষার মধ্যে কাটাচ্ছে রাত।

কিছু মানুষ যখন সাহায্য পায়, তা পারস্পরিকভাবে ভাগ করে খায়। কেউ যদি দুটি কম্বল পায়, দ্বিতীয়টি পাশে থাকা অন্য বৃদ্ধের জন্য রেখে দেয়। ফুটপাত থাকলেও এই মানুষগুলো অমানবিক নয়; কঠিন জীবন তাদের একে অপরের প্রতি আরও মানবিক করে তুলেছে।

শীত ঢাকা শহরের জন্য হয়তো এক-দেড় মাসের ঋতু, কিন্তু ফুটপাথের মানুষের কাছে তা এক ভয়ঙ্কর বাস্তবতা যা বাঁচার সংগ্রামকে আরও কঠিন করে তোলে। সদরঘাট, নিউমার্কেট, তেজগাঁও, গাবতলী—এই শহরের ব্যস্ততম রাস্তা হলেও যারা এই চক্রের বাইরে, তাদের রাতগুলো অন্ধকার, শীতল ও অনিশ্চয়তায় ভরা। তবুও তারা বাঁচে, বেঁচে থাকার এই সংগ্রাম আমাদের স্মরণ করায়—এই শহর কি সত্যিই সব মানুষকে সমানভাবে ধরে রাখতে পারে?