দেশের ব্যাংকিং খাতে দীর্ঘদিনের অনিয়ম, দুর্বল নজরদারি ও প্রভাবশালীদের প্রতি শিথিলতার কারণে পরিস্থিতি ক্রমেই জটিল হচ্ছে বলে পর্যবেক্ষণ করেছেন খাতসংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা। বিভিন্ন গবেষণা প্রতিবেদন, বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য এবং খাতের অভ্যন্তরীণ সূত্রের বরাতে জানা গেছে—গত এক দশকের বেশি সময়ে ব্যাংক ঋণ বিতরণে ব্যাপক অনিয়মের ফলে বর্তমানে একাধিক ব্যাংক দেউলিয়া হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে।
খেলাপি ঋণে রেকর্ড বৃদ্ধি
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে দেখা যায়,
-
২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংক খাতে মোট বিতরণকৃত ঋণ ছিল ১৮ লাখ কোটি টাকা,
-
যার মধ্যে খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ৬ লাখ ৪৪ হাজার কোটি টাকা—মোট বিতরণকৃত ঋণের ৩৫.৭৩ শতাংশ।
এক বছর আগে একই সময়ে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ২ লাখ ৮৫ হাজার কোটি টাকা বা ১৬.৯৩ শতাংশ। অর্থাৎ বছরে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৩ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকার বেশি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ত্রৈমাসিক (Q1–Q2) প্রতিবেদন অনুযায়ী—
-
২০২৩ সালের জুনে নন-পারফর্মিং লোনের (NPL) হার ছিল ১২.২%,
-
যা ২০২৪ সালের মার্চে বেড়ে দাঁড়ায় ২৪.৬%।
২০২৪ সালের জুন শেষে মোট ঋণ–অগ্রিম দাঁড়িয়েছে ১৭ লাখ ৩৪ হাজার ২০০ কোটি টাকা, যার মধ্যে ৫ লাখ ৯৯ হাজার ৯৬৪ কোটি টাকা খেলাপিতে পরিণত হয়েছে। এক বছরে খেলাপি ঋণ বৃদ্ধি পেয়েছে ৩ লাখ ৮৮ হাজার ৫৭৩ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, খেলাপি, রাইট-অফ, পুনঃতফসিল ও মামলাজট—সব মিলিয়ে ব্যাংক খাতে অচিরেই খারাপ ঋণের পরিমাণ ১০ লাখ কোটি টাকা ছাড়াতে পারে।
ঝুঁকিতে অন্তত ১২টি ব্যাংক
বিভিন্ন গবেষণা সংস্থা ও ব্যাংক সূত্রের দাবি, অন্তত ১২টি ব্যাংক দেউলিয়া হওয়ার ঝুঁকিতে, আর ১৫টি ব্যাংক টিকে থাকার সংগ্রামে রয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক নিয়মকানুন কঠোরভাবে প্রয়োগ করায় অনেক ‘লুকানো’ খেলাপি ঋণ এখন প্রকাশ পাচ্ছে।
এক কর্মকর্তা জানান—
“আগে যেসব ঋণ নিয়মিত হিসেবে দেখানো হতো, তার বড় অংশই আসলে ছিল ঝুঁকিপূর্ণ। নতুন মনিটরিং ব্যবস্থার ফলে প্রকৃত অবস্থা স্পষ্ট হয়েছে।”
গবেষকরা বলছেন
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন—
“খেলাপি ঋণের অত্যধিক চাপের কারণে ব্যাংকিং খাত এখন চরম সংকটে। সুদের হার স্থিতিশীল রাখা যাচ্ছে না, পলিসি রেট কমানো যাচ্ছে না। উদ্যোক্তাদের উচ্চ সুদে ঋণ নিতে হচ্ছে—যা বিনিয়োগকে বাধাগ্রস্ত করছে।”
তিনি আরও বলেন—
“বর্তমানে স্বচ্ছতার চর্চা বেড়েছে। ফলে অতীতে যেসব ঋণ গোপন রাখা হয়েছিল, সেগুলো এখন দৃশ্যমান হচ্ছে।”
বড় গ্রুপগুলোর বিরুদ্ধে অভিযোগ
বিভিন্ন ব্যাংক ও বেসরকারি গবেষণা প্রতিবেদনে একাধিক শিল্পগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে বিপুল ঋণ জালিয়াতি ও অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া যায়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য অভিযোগসমূহ হলো—
এস আলম গ্রুপ
-
অভিযোগ: জালিয়াতির মাধ্যমে ২ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা সরানোর অভিযোগ।
-
এর মধ্যে প্রায় ১ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা পাচারের অভিযোগ রয়েছে।
-
খেলাপি ঋণ: ৪০ হাজার কোটি টাকা।
বেক্সিমকো গ্রুপ
-
মোট ঋণের অভিযোগিত অনিয়ম: ৫৩ হাজার কোটি টাকা
-
খেলাপি: ২০,৫১৬ কোটি টাকা
সিকদার গ্রুপ
-
মোট ঋণ: ১৩ হাজার কোটি টাকা
-
খেলাপি: ২,১০০ কোটি টাকা
নাসা গ্রুপ
-
অপরিশোধিত ঋণ: ৯,২১৫ কোটি টাকা
ওরিয়ন গ্রুপ
-
অপরিশোধিত ঋণ: ১০ হাজার কোটি টাকা,
-
খেলাপি: ১,৫০০ কোটি টাকা
নাবিল গ্রুপ
-
অপরিশোধিত ঋণ: ৯,৪০৫ কোটি টাকা,
-
খেলাপি: ৭,০০০ কোটি টাকা
অন্যান্য অভিযোগ
একটি চট্টগ্রামভিত্তিক বড় ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর বিরুদ্ধেও বিপুল ঋণ অনিয়মের তথ্য রয়েছে। ২০১৭ সাল থেকে এসব অনিয়ম বাড়তে থাকে এবং ২০২১–২০২৩ সালকে খাতসংশ্লিষ্টরা লুটপাটের “সবচেয়ে ভয়াবহ সময়” বলে উল্লেখ করেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তালিকা অনুসারে, ছোট–বড় মিলিয়ে প্রায় ৩০০ প্রতিষ্ঠান বর্তমানে খেলাপি ঋণের সঙ্গে জড়িত।
সমাপনী পর্যবেক্ষণ
অর্থনীতিবিদদের মতে, ব্যাপক ঋণ খেলাপি, দুর্বল শাসনব্যবস্থা, রাজনৈতিক প্রভাব ও শিথিল নজরদারি ব্যাংকিং খাতকে একটি দীর্ঘমেয়াদি সংকটের দিকে ঠেলে দিয়েছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে—
-
খেলাপি ঋণ পুনরুদ্ধারে কঠোর পদক্ষেপ,
-
ব্যাংক পরিচালনায় রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ কমানো,
-
দায়ীদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা,
-
এবং দেউলিয়া ঝুঁকিতে থাকা ব্যাংকগুলোর পুনর্গঠন—
এসবকে জরুরি প্রয়োজন বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।