ঢাকা, মঙ্গলবার, ১৬ ডিসেম্বর ২০২৫,
সময়: ০৯:৫৩:১৪ PM

নিঃশব্দ ছায়া, পর্ব – ১৬**১৭**

মান্নান মারুফ
16-12-2025 07:28:35 PM
নিঃশব্দ ছায়া, পর্ব – ১৬**১৭**

ভোরের আলো তখনো পুরোপুরি জানালার কাঁচ ভেদ করে ঢুকতে পারেনি। ঘুম ভাঙার পর কলি নীরবে বিছানা ছাড়ল। হাত-মুখ ধুয়ে আয়নায় নিজের দিকে তাকিয়ে এক মুহূর্ত থমকে দাঁড়াল সে। গত কয়েকদিন ধরে অদ্ভুত এক অস্বস্তি বুকের ভেতর বাসা বেঁধেছে—কারণটা ঠিক বুঝে উঠতে পারে না। রান্নাঘর থেকে হালকা চায়ের গন্ধ ভেসে আসছিল। নাস্তার টেবিলে বসতেই মনটা একটু হালকা হলো।

ঠিক সেই সময় ফোনটা বেজে উঠল।

অচেনা নয়, বহুদিনের চেনা নামটাই স্ক্রিনে ভেসে উঠেছে—বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের বন্ধু, রাহাত। কলি ফোন কানে তুলতেই ওপ্রান্ত থেকে কাঁপা কণ্ঠ ভেসে এলো,
“কলি, তুমি জানো কিছু?”

কলি ভ্রু কুঁচকে বলল, “কী জানব? কী হয়েছে?”

এক মুহূর্ত নীরবতা। তারপর রাহাত ধীরে ধীরে বলল,
“নীল… নীলকে আজ ভোরে এক্সিডেন্ট করেছে।”

কলির হাত থেকে চায়ের কাপটা প্রায় পড়ে যাচ্ছিল। বুকের ভেতর কেমন করে উঠল।
“কী বলছ তুমি? কেমন এক্সিডেন্ট?”

রাহাতের কণ্ঠ আরও ভারী হয়ে এলো। “নীল আজ সকালে তোমার সঙ্গে দেখা করতে বাড়ি থেকে বের হয়েছিল। বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে বাসের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে ছিল। হঠাৎ উল্টো দিক থেকে একটা গাড়ি বেপরোয়া গতিতে এসে ওর ওপর উঠে যায়।”

কলির মাথার ভেতর যেন শব্দগুলো ঘুরপাক খেতে লাগল। নীল… তার কাছে আসছিল? কেন? গত কয়েক মাসে তো তাদের যোগাযোগ প্রায় নেই বললেই চলে।

“ও… ও এখন কেমন?” কলি কষ্ট করে প্রশ্নটা করল।

“পথচারীরা সঙ্গে সঙ্গে ওকে ধরে হাসপাতালে নিয়ে যায়। ও মারাত্মকভাবে আহত হয়েছে। তবে আশ্চর্যভাবে তখনও অল্প অল্প কথা বলতে পারছিল।”

ফোনটা কেটে যাওয়ার পর কলি চুপচাপ বসে রইল। চারপাশের সব শব্দ যেন হঠাৎ থেমে গেছে। নাস্তার টেবিল, চায়ের কাপ, জানালার বাইরের আলো—সবকিছু অর্থহীন মনে হলো। তার মনে পড়ল, বিশ্ববিদ্যালয়ের দিনগুলোতে নীলের সঙ্গে কাটানো অগণিত মুহূর্ত। নীল ছিল সবসময় নীরব, অথচ চোখের ভেতর জমে থাকত অদ্ভুত এক গভীরতা। অনেক কথা না বলেও সে যেন সব বুঝে নিত।

কলি দ্রুত ব্যাগ গুছিয়ে বেরিয়ে পড়ল। হাসপাতালের করিডোরে পৌঁছে তার মনে হলো, সময় যেন এখানে এসে থমকে আছে। সাদা দেয়াল, জীবাণুনাশকের গন্ধ আর মানুষের চাপা কান্না—সব মিলিয়ে এক ভারী পরিবেশ।

আইসিইউর বাইরে দাঁড়িয়ে কলির বুক ধড়ফড় করতে লাগল। ভেতরে শুয়ে আছে নীল। সেই নীল, যে একসময় তার নীরব সঙ্গী ছিল। ডাক্তার জানালেন, আঘাত গুরুতর, তবে এখনো পুরোপুরি আশাহীন নয়। কয়েক ঘণ্টা খুব গুরুত্বপূর্ণ।

কাঁচের দেয়াল দিয়ে ভেতরে তাকিয়ে কলি নীলকে দেখল। চোখ বন্ধ, মুখে ক্লান্তির ছাপ। তবু ঠোঁটের কোণে যেন অল্প এক শান্তির রেখা। কলির চোখ ভিজে উঠল। সে বুঝতে পারল, কিছু ছায়া থাকে যেগুলো শব্দ করে না, কিন্তু জীবনের সবচেয়ে গভীর জায়গাগুলো জুড়ে বসে থাকে।

নীল হয়তো আজ কথা বলতে পারবে না, হয়তো অনেক প্রশ্নের উত্তর আর পাওয়া যাবে না। তবু কলি সিদ্ধান্ত নিল—এই নীরবতার পাশে সে থাকবে। কারণ কিছু সম্পর্ক শব্দে নয়, নীরব ছায়ার মতোই টিকে থাকে, সময়ের সব আঘাত সহ্য করে।

নিঃশব্দ ছায়া
পর্ব – ১৭

নীল ধীরে ধীরে চোখ মেলার চেষ্টা করছিল। চোখের পাতা ভারী, শরীরের প্রতিটি অঙ্গ যেন অদৃশ্য শেকলে বাঁধা। চারপাশে অস্পষ্ট শব্দ—যন্ত্রের বিপ শব্দ, কারও ফিসফিস কথা, দূরে কোথাও দৌড়ানোর আওয়াজ। হঠাৎ তার দৃষ্টির সামনে একটি পরিচিত অবয়ব ভেসে উঠল। ঝাপসা চোখেও সে ভুল করতে পারল না।

কলি।

নীল ঠোঁট নড়াতে চাইল। গলা শুকিয়ে কাঠ। বুকের ভেতর জমে থাকা কথাগুলো যেন একসঙ্গে বেরিয়ে আসতে চাইছে, অথচ শরীর সাড়া দিচ্ছে না। অনেক কষ্টে চোখ বন্ধ করে ক্ষীণ কণ্ঠে বলল,
“ক্ষমা করে দিও…”

কলির বুকটা কেঁপে উঠল। সে দ্রুত এগিয়ে এসে নীলের হাতটা ধরে ফেলল। হাতটা ঠান্ডা, নিস্তেজ।
“এভাবে কথা বলো না, নীল। কিছু হবে না। তুমি ঠিক হয়ে যাবে,” কলি কাঁপা কণ্ঠে বলল।

নীল যেন তার কথা শুনতে পেল না। চোখ বন্ধ রেখেই আবার বলল,
“আমি… আমি চলে যাচ্ছি…”

এই কথাটুকু কলির বুকের ভেতর ছুরি হয়ে বিঁধল।
“চুপ করো!” সে প্রায় চিৎকার করেই বলল। “এমন কথা কেউ বলে? তুমি কোথাও যাচ্ছ না।”

নীল সামান্য হাসার চেষ্টা করল। সেই হাসিতে ছিল গভীর ক্লান্তি আর অপূর্ণতার ছাপ।
“জানি… তোমাকে অনেক কষ্ট দিয়েছি,” সে ফিসফিস করে বলল। “সব কথা… বলা হয়নি।”

কলির চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। তার মনে পড়ল, কতবার সে নীলের নীরবতাকে অবহেলা করেছে। ভেবেছে, নীল বুঝি কিছুই চায় না, কিছুই বলার নেই। অথচ আজ, এই হাসপাতালের শীতল বিছানায় শুয়ে থাকা মানুষটার চোখের আড়ালে লুকিয়ে ছিল কত না বলা কথা।

“কী ক্ষমা চাইছ তুমি?” কলি বলল। “তুমি তো কোনো অপরাধ করোনি।”

নীল মাথা নড়ানোর চেষ্টা করল।
“করেছি… তোমার পাশে থাকতে পারিনি। সাহস হয়নি সত্যিটা বলার,” সে কষ্ট করে শ্বাস নিল। “ভেবেছিলাম সময় আছে… কিন্তু সময়… কারও জন্য অপেক্ষা করে না।”

ডাক্তারেরা এসে নীলের চারপাশে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। কলিকে একটু দূরে সরে যেতে বলা হলো। সে পেছনে দাঁড়িয়ে নীলের দিকে তাকিয়ে রইল। প্রতিটি মুহূর্ত যেন অনন্তকাল দীর্ঘ। যন্ত্রের শব্দ আরও জোরালো হয়ে উঠল।

কলির মনে হতে লাগল, এই নিঃশব্দতার ভেতরেই নীল ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছে। তার চোখের সামনে ভেসে উঠল বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস, বিকেলের আলো, নীলের চুপচাপ পাশে বসে থাকা। সে বুঝতে পারল, নীল সবসময়ই তার জীবনের ছায়া হয়ে ছিল—কখনো সামনে আসেনি, কখনো দাবি করেনি, তবু সবকিছু জুড়ে ছিল।

হঠাৎ নীল আবার চোখ মেলল। এইবার দৃষ্টি একটু স্পষ্ট। কলির দিকে তাকিয়ে ঠোঁট নড়ল, শব্দ প্রায় শোনা গেল না, তবু কলি বুঝে নিল।
“থেকো… শক্ত থেকো…”

কলি আর নিজেকে সামলাতে পারল না। সে এগিয়ে এসে বলল,
“তুমি বাঁচবে, নীল। তোমাকে বাঁচতেই হবে। আমি এখনো অনেক কথা শোনার অপেক্ষায় আছি।”

নীল চোখ বন্ধ করল। তার মুখে এক ধরনের শান্তি। যেন সে তার বলা শেষ কথাটুকু বলে হালকা হয়ে গেছে।

ডাক্তারের কণ্ঠ ভেসে এলো—“আমরা চেষ্টা করছি।”

কলি জানত, এই চেষ্টা শুধু ডাক্তারদের নয়। এই চেষ্টা তারও—নীলকে ধরে রাখার, নীরব ছায়াকে আলোয় ফিরিয়ে আনার। কারণ কিছু বিদায় এমন থাকে, যেগুলো মেনে নেওয়া যায় না। আর কিছু ক্ষমা এমন থাকে, যেগুলো চাওয়ার আগেই দিয়ে দেওয়া হয়। #