ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৮ ডিসেম্বর ২০২৫,
সময়: ১০:২২:২৫ PM

উপন্যাস, ছোট্ট আনিসা, পর্ব-১,পর্ব-২

মান্নান মারুফ
18-12-2025 07:51:11 PM
উপন্যাস, ছোট্ট আনিসা, পর্ব-১,পর্ব-২

মা চলে গেছেন পরপারে। বাবাও দায়িত্ব ভুলে হারিয়ে গেছেন অজানায়। ফুটপাতে খোলা আকাশের নিচে এখন ছোট্ট আনিসার ঠিকানা—শীতল পাথরে বসে, ভেজা চোখে তাকিয়ে থাকে মানুষের দিকে।

ঢাকার এক ব্যস্ত মোড়। সারাদিন গাড়ির হর্ন, মানুষের চিৎকার, ফেরিওয়ালার ডাক—সব মিলিয়ে একটানা কোলাহল। এই শব্দের ভিড়েই আনিসা বসে থাকে। বয়স বড়জোর দশ কি এগারো। কিন্তু তার চোখে বয়সের হিসাব নেই, আছে শুধু ক্লান্তি আর ভয়। কোলের বোনটা—ছয় মাসও হয়নি—ক্ষুধায় কাঁদে। কান্নাটা প্রথমে আস্তে, পরে ধীরে ধীরে বুক ফাটানো আর্তনাদে রূপ নেয়।

বোনটার মুখে দুধ নেই। আনিসা জানে, কান্না থামাতে হলে দুধ লাগবে। দুধ কিনতে হলে টাকা। আর টাকা পেতে হলে—ভিক্ষার থালা।

একটা ছোট্ট অ্যালুমিনিয়ামের থালা। কোথা থেকে পেয়েছে, নিজেও জানে না। একদিন রাস্তায় কুড়িয়ে পেয়েছিল। সেই দিন থেকেই থালাটাই তার সম্বল। থালাটা হাতে নিয়ে সে মানুষের দিকে তাকায়। কিছু বলে না। শুধু তাকায়। অনেকেই তাকিয়ে মুখ ফিরিয়ে নেয়। কেউ কেউ ব্যস্ত পায়ে পাশ কাটিয়ে চলে যায়। দু-একজন কয়েন ছুড়ে দেয়—মুখে বিরক্তির ছাপ, যেন দায় সেরেছে।

আনিসার মনে পড়ে—একসময় তারও স্কুল ছিল। একটা ছোট্ট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। মাটির রঙের ইউনিফর্ম, কাঁধে ছেঁড়া ব্যাগ। মা নিজ হাতে চুল বেঁধে দিতেন। বলতেন, “পড়বি মা, মানুষ হবি।” সেই মা-ই একদিন জ্বরে পড়ে বিছানায় শুয়ে থাকলেন। ওষুধ কেনার টাকা ছিল না। কয়েকদিনের মধ্যেই মা তাদের ছেড়ে অজানা গন্তব্য চলে গেলেন।

মায়ের মৃত্যুর পর বাবাও বদলে গেল। প্রথম দিকে চুপচাপ থাকতেন। তারপর একদিন রাগ করে বেরিয়ে গেলেন ওদের কাছ থেকে। বলেছিলেন, ‘আমি আর পারছি না।’ তারপর আর ফেরেননি। না কোন দিন ফেরেনি।

সেই দিন থেকেই আনিসা বড় হয়ে গেল।

আজ ফুটপাতে বসে থাকা আনিসা আর সেই স্কুলপড়ুয়া মেয়েটা এক নয়। এখন তার দায়িত্ব আছে—একটা জীবন্ত মানুষ, তার বোন। বোনটার নিঃশ্বাসের শব্দ শুনে সে বুঝতে পারে, এখনও বেঁচে আছে। আর এই বেঁচে থাকাটুকুই তার লড়াই।

বিকেলের দিকে বাতাস ঠান্ডা হয়ে আসে। আকাশে মেঘ জমে। শীতল পাথর থেকে ঠান্ডা উঠে এসে শরীর কাঁপায়। আনিসা নিজের ছেঁড়া ওড়নাটা বোনটার গায়ে জড়িয়ে দেয়। নিজে ঠান্ডায় কাঁপলেও বোনটাকে কাঁপতে দিতে চায় নি সে।

হঠাৎ একজন মাঝবয়সী মহিলা সামনে দাঁড়ান। ভালো করে তাকান আনিসার দিকে, তারপর কোলের শিশুটার দিকে। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে ব্যাগ থেকে একটা দশ টাকার নোট বের করে থালায় রাখেন। আনিসা মাথা নিচু করে ফিসফিস করে বলে, “আল্লাহ ভালো রাখুক।”

দশ টাকায় দুধ হয় না। কিন্তু থালায় আজ এটাই সবচেয়ে বড় টাকা। আনিসা হিসাব কষে—আর কুড়ি টাকা হলে এক প্যাকেট গুঁড়ো দুধ কেনা যাবে। সে বারবার মানুষ দেখলেই থালাটা সামনের দিকে বাড়িয়ে দেয়।

আকাশে তখন সন্ধ্যার আলো। রাস্তার লাইটগুলো একে একে জ্বলে উঠছে। শহর জেগে উঠছে, আর আনিসা আরও একবার নিজেকে শক্ত করে নেয়। আজ রাতটা পার করতে হবে। বোনটার কান্না থামাতে হবে।

এই ফুটপাতেই আজ তার সংসার। এই খোলা আকাশের নিচেই তার স্বপ্ন—যদিও সে জানে না, স্বপ্ন কাকে বলে। তবু বুকের গভীরে কোথাও একটা ক্ষীণ আশা জ্বলে থাকে—কাল হয়তো একটু ভালো হবে।

ছোট্ট আনিসা — পর্ব -

রাত নামে ঢাকার আকাশে ধীরে ধীরে, যেন কারও অজান্তে। দিনের কোলাহল কিছুটা থেমে আসে, কিন্তু ফুটপাতে আনিসার লড়াই তখনও শেষ হয় না। রাস্তার বাতিগুলো জ্বলে উঠলে ছায়াগুলো লম্বা হয়, আর সেই ছায়ার ভেতরেই সে বসে থাকে—কোলের ছোট বোনটাকে শক্ত করে জড়িয়ে।

সন্ধ্যার পর মানুষের চোখ বদলে যায়। দিনের আলোয় যারা পাশ কাটিয়ে যায়, রাতে তারা আরও দ্রুত হাঁটে। কেউ ভিক্ষার থালার দিকে তাকায় না। কেউ তাকালেও সন্দেহে চোখ কুঁচকে নেয়। আনিসা বুঝতে পারে—রাত মানেই ভয়।

বোনটার কান্না থেমেছে কিছুক্ষণ আগে। ক্ষুধায় কাঁদতে কাঁদতে সে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। ছোট্ট বুকটা উঠানামা করছে ধীরে। আনিসা থালার ভেতর তাকায়। হিসাব করে দেখে—আজ মোটে ত্রিশ টাকা। দুধ কিনতে হলে আর দশ টাকা দরকার।

সে উঠে দাঁড়ায়। পা দুটো অবশ হয়ে এসেছে, তবু দাঁড়াতেই হয়। সামনে একটা চায়ের দোকান, তার পাশে ছোট একটা মুদির দোকান। দোকানটার তাকেই ঝুলছে গুঁড়ো দুধের প্যাকেট। আনিসার চোখ আটকে থাকে সেদিকে।

দোকানদার লোকটা মোটা গলায় চেঁচিয়ে কথা বলছে। আনিসা ধীরে ধীরে এগিয়ে যায়। থালাটা সামনে ধরে ফিসফিস করে বলে, “চাচা, দুধ কিনতে টাকা কম…।”

লোকটা তাকায়, তারপর কোলের শিশুটার দিকে। এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলে, “যা আছে দে।”

আনিসা থালার সব টাকা ঢেলে দেয় কাউন্টারে। লোকটা গুনে দেখে, তারপর তাক থেকে ছোট একটা প্যাকেট নামিয়ে দেয়। “এই নে, ছোটটা।”

প্যাকেটটা হাতে পেয়ে আনিসার বুকটা হালকা হয়ে আসে। যেন আজকের যুদ্ধটা অন্তত জেতা গেছে।

দুধ বানানোর পানি নেই। সে পাশের চায়ের দোকানে যায়। দোকানের বুড়ো চাচা প্রথমে বিরক্ত হলেও শেষে একটা কাপের অর্ধেক গরম পানি দেয়। আনিসা নিজের পুরোনো বোতলে দুধ গুলে নেয়। কাঁপা হাতে বোতলটা বোনটার মুখে ধরতেই শিশুটি টান দিয়ে ধরেছে।

এই দৃশ্য দেখে আনিসার চোখ ভিজে ওঠে। আনন্দে নয়—অজানা কষ্টে। সে জানে, আজকের রাত পার হলেও কাল আবার এই লড়াই করতে হবে।

খাওয়ানো শেষ হতে হতেই বোনটা গভীর ঘুমে ডুবে যায়। আনিসা ফুটপাতে বসে আকাশের দিকে তাকায়। তারা দেখা যায় না, আলো আর ধোঁয়ায় ঢাকা। তবু সে আকাশের দিকে তাকিয়েই ভাবে—মা কি এখান থেকে দেখতে পান?

তার মনে পড়ে মায়ের কথা। মা বলতেন, “আল্লাহ কাউকে না খাইয়ে রাখে না।” তখন কথাটার মানে বুঝত না। এখন বোঝে—কথাটা বিশ্বাস ছাড়া আর কিছু নয়।

হঠাৎ পাশ থেকে একটা কণ্ঠ শোনা যায়, “এই মেয়ে, এখানে একা থাকিস কেন?”

আনিসা চমকে ওঠে। দেখে, কাছেই বসে আছে এক বৃদ্ধা—মাথায় সাদা ওড়না, চোখে ক্লান্তির ছাপ। বৃদ্ধা নিজের গুটানো কাপড়ের পোটলা পাশে রেখে বসেছে।

“কেউ নেই,” আস্তে বলে আনিসা।

বৃদ্ধা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। “আমারও কেউ নেই রে। রাস্তাই এখন আমার ঘর।”   

বৃদ্ধা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। “আমারও কেউ নেই রে। রাস্তাই এখন ঘর।”

দুজনেই চুপ করে থাকে কিছুক্ষণ। দুটো নিঃসঙ্গ মানুষ, পাশাপাশি বসে। এই নীরবতাতেই জন্ম নেয় এক অদ্ভুত সাহচর্য।

রাত আরও গভীর হয়। বাতাস ঠান্ডা লাগে। বৃদ্ধা নিজের ওড়নার এক কোণা খুলে বোনটার পায়ে ঢেকে দেয়। বলে, “বাচ্চাটা ঠান্ডা লাগবে।”

এই ছোট্ট যত্ন আনিসার কাছে অনেক বড় হয়ে ধরা দেয়। সে প্রথমবারের মতো বুঝতে পারে—সব মানুষ খারাপ নয়।

চোখ বন্ধ করলে তার ভেতরে একটুখানি সাহস জমে। হয়তো কাল এই বৃদ্ধা পাশে থাকবে। হয়তো কেউ আবার দুধের টাকা দেবে।

ফুটপাতে শুয়ে, খোলা আকাশের নিচে, আনিসা নিজেকে বোঝায়—বেঁচে থাকাটাই আজ তার সবচেয়ে বড় জয়।

 চলবে-----