ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৮ ডিসেম্বর ২০২৫,
সময়: ১০:২৪:০৩ PM

উপন্যাস, ছোট্ট আনিসা,পর্ব -৩-৪

মান্নান মারুফ
18-12-2025 08:26:03 PM
উপন্যাস, ছোট্ট আনিসা,পর্ব -৩-৪

ভোর আসে ধীরে, খুব নিঃশব্দে। ফুটপাতে শুয়ে থাকা মানুষগুলো আগে টেরই পায় না। আনিসার চোখ খুলে যায় আজানের শব্দে। দূরের মসজিদ থেকে ভেসে আসা ডাক তার ঘুম ভাঙায়। কোলের বোনটা এখনও ঘুমাচ্ছে, ছোট্ট হাতটা শক্ত করে তার জামা ধরে আছে, রাতটা কোনোমতে কেটে গেছে। পাশেই বসে থাকা বৃদ্ধা নারীটা—যার নাম এখনও জানা হয়নি—চুপচাপ নামাজ পড়ে। নামাজ শেষে সে আনিসার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসে। সেই হাসিতে ছিল মায়া , ভয় নেই।

“নাম কী তোর?” বৃদ্ধা জিজ্ঞেস করে।

“আনিসা,” আস্তে বলে সে।

“বোনটার?”

“রিমা।”

বৃদ্ধা মাথা নেড়ে বলে, “আল্লাহ রিমাকে হেফাজতে রাখুক।”

আনিসার বুকটা একটু হালকা হয়। কেউ নাম ধরে ডাকলে তার ভেতরে অদ্ভুত একটা ভরসা জাগে।

সূর্য উঠতে শুরু করে। রাস্তার পাশে দোকানগুলো একে একে খুলছে। ঝাড়ু দেওয়া হচ্ছে ফুটপাত। আনিসা তাড়াতাড়ি উঠে বসে, কারণ ঝাড়ুদাররা কখনও কখনও বকাঝকা করে তাড়িয়ে দেয়।

“আজ কোথায় যাবি?” বৃদ্ধা জিজ্ঞেস করে।

আনিসা জানে না। কোথায় যাবে? এই ফুটপাতই তো তার ঠিকানা। সে কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলে, “এইখানেই থাকব।”

বৃদ্ধা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে, “আমি থাকি রেললাইনের পাশে। চাইলে আমার সাথে আসতে পারিস। একা থাকলেও ভয় কম হবে।”কারন পরিচিত।

আনিসা দ্বিধায় পড়ে। নতুন জায়গা মানেই নতুন ভয়। কিন্তু একা থাকার ভয়ও কম নয়। বোনটার দিকে তাকায়। সিদ্ধান্ত নেয়—আজ বৃদ্ধার সাথেই যাবে।

দুজন হাঁটতে শুরু করে। আনিসার কোলে রিমা, হাতে ভিক্ষার থালা। রেললাইনের ধারে পৌঁছাতে সময় লাগে অনেক। সেখানে আরও অনেক মানুষ—কেউ ভাঙা প্লাস্টিকের ছাউনি দিয়েছে, কেউ পুরোনো বস্তা পেতে শুয়েছে।

এই জায়গাটা ভয়ংকর, কিন্তু পরিচিত দুঃখে ভরা।

বৃদ্ধা একটা ফাঁকা জায়গা দেখিয়ে বলে, “এইখানে থাকি আমি।”

আনিসা বসে পড়ে। রিমা আবার কাঁদতে শুরু করেছে। দুধ শেষ। আবার সেই পুরোনো চিন্তা—টাকা।

সে রেললাইনের পাশের পথ ধরে দাঁড়ায়। ট্রেন এলে মানুষ থামে, কেউ কেউ কয়েন দেয়। আজ ভাগ্য ভালো—একজন যুবক পাঁচ টাকা দেয়, এক মহিলা দেয় দশ টাকা।

আনিসা খুশি হয় না, শুধু হিসাব করে। আজ দুপুরের দুধ জুটবে কি না—সেই হিসাব।

হঠাৎ পুলিশ আসে। সবাই নড়েচড়ে ওঠে। কেউ দৌড় দেয়, কেউ মালপত্র গুটিয়ে নেয়। আনিসার বুক ধকধক করে। সে দৌড়াতে পারে না—কোলে বোন।

একজন পুলিশ কাছে এসে বলে, “এইখানে বসে আছিস কেন?”

আনিসার গলা শুকিয়ে যায়। ভয়ে কথা বের হয় না।

বৃদ্ধা এগিয়ে আসে। বলে, “সার, এতিম বাচ্চা। যাওয়ার জায়গা নাই।”

পুলিশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। বলে, “বেশি ঝামেলা করিস না।”

তারা বেঁচে যায়।

এই ছোট্ট ঘটনার পর আনিসা বুঝে যায়—এই শহরে টিকে থাকতে হলে শুধু ক্ষুধা নয়, ভয়কেও সামলাতে হয়।

বিকেলে রিমা আবার দুধ খায়। আনিসা বোনটার মুখের দিকে তাকিয়ে ভাবে—এই শিশুটার জন্যই তাকে বাঁচতে হবে।

সন্ধ্যায় আকাশ লালচে হয়। ট্রেনের শব্দে মাটি কাঁপে। আনিসা বৃদ্ধার পাশে বসে থাকে।

আজ সে প্রথমবার অনুভব করে—একটা পরিবার মানে শুধু রক্তের সম্পর্ক নয়। পাশে বসে থাকা মানুষটাও পরিবার হতে পারে।

তার ভেতরে নতুন একটা আশা জন্ম নেয়। ভয় এখনও আছে, কিন্তু ভয়কে ছাড়িয়ে আজ একটু সাহস বড় হয়ে উঠেছে।

ছোট্ট আনিসা — পর্ব-

সকালের রোদ রেললাইনের ধারে এসে পড়তেই জায়গাটা একটু উষ্ণ হয়ে ওঠে। রাতে যে ভয় আর অস্থিরতা ছিল, দিনের আলোয় তা কিছুটা হালকা মনে হয়। আনিসা ঘুম থেকে উঠে চারপাশে তাকায়। বস্তা, পলিথিন, ভাঙা কার্ডবোর্ড—এগুলোই এখন ঘরবাড়ি।

রিমা কোলের ভেতর নড়েচড়ে উঠছে। ক্ষুধার সংকেত আনিসা ভালো করেই চেনে। সে বোনটাকে বুকে চেপে ধরে শান্ত করার চেষ্টা করে। দুধ নেই—এই সত্যটা বুকের ভেতর পাথরের মতো বসে থাকে।

বৃদ্ধা নারীটি পাশে বসে চুল আঁচড়াচ্ছিল। সে আনিসার দিকে তাকিয়ে বলে, “আজকে কিছু কাজ খুঁজে দেখবি? শুধু ভিক্ষায় সব সময় হয় না।”

‘কাজ’—শব্দটা আনিসার কানে নতুন লাগে। সে কখনও কাজ করেনি। তবে স্কুলে থাকতে সে ভালো করে ঝাড়ু দিত, বই গুছিয়ে রাখত।

“আমি পারব?” প্রশ্নটা অনিশ্চয়তায় ভেজা।

বৃদ্ধা মৃদু হাসে। “পারবি। তুই তো অনেক কিছুই পারিস, শুধু জানিস না।”

এই কথাটা আনিসার মনে গেঁথে যায়।

দুজন রেললাইন ছেড়ে বাজারের দিকে হাঁটে। ভিড় বাড়তে থাকে। মাছের গন্ধ, সবজির চিৎকার, মানুষের হাঁকডাক—সব মিলিয়ে বাজারের আলাদা এক জগৎ।

একটা সবজির দোকানে গিয়ে বৃদ্ধা দাঁড়ায়। দোকানদার লোকটা রুক্ষ স্বরে কথা বলে, কিন্তু বৃদ্ধাকে চেনে।

“এই মেয়ে ঝাড়ু দেবে, ময়লা পরিষ্কার করবে,” বৃদ্ধা বলে।

লোকটা আনিসার দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ায়। “এক ঘণ্টা। দশ টাকা।”

দশ টাকা শুনে আনিসার চোখ চকচক করে ওঠে। সে সঙ্গে সঙ্গে কাজে লেগে যায়। মেঝেতে পড়ে থাকা পাতা, ময়লা, খালি থলে—সব গুছিয়ে নেয়। কেউ কেউ অবাক হয়ে তাকায়—এত ছোট মেয়ে কাজ করছে!

এক ঘণ্টা শেষে দোকানদার কথা রাখে। দশ টাকা দেয়। হাতে টাকা পেয়ে আনিসার মনে হয়, এটা ভিক্ষার টাকা নয়—এটা তার নিজের উপার্জন। বুকের ভেতর অদ্ভুত গর্ব জন্ম নেয়।

সে তাড়াতাড়ি দুধ কিনে আনে। রিমা দুধ খেয়ে শান্ত হয়। এই শান্ত মুখটাই আনিসার সবচেয়ে বড় পুরস্কার।

কিন্তু সুখ বেশিক্ষণ থাকে না। দুপুরের দিকে বাজারে হট্টগোল। দুজন দোকানদারের ঝগড়া, তারপর ধাক্কাধাক্কি। পুলিশ আসে। সবাই ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়।

আনিসা ভয় পেয়ে বোনটাকে শক্ত করে ধরে। সে ভাবে—এই জায়গায় থাকাও কি ঠিক? আবার কি পালাতে হবে?

বৃদ্ধা এসে পাশে দাঁড়ায়। “ভয় পাস না। সব সময় ঝড় থাকে না।”

এই কথায় আনিসা একটু সাহস পায়।

বিকেলে তারা আবার রেললাইনের ধারে ফেরে। আনিসা ক্লান্ত, তবু মনটা অন্যরকম শান্ত। আজ সে ভিক্ষা করেনি—কাজ করেছে।

সে আকাশের দিকে তাকায়। মায়ের মুখ মনে পড়ে। যদি মা বেঁচে থাকতেন, আজ কি খুশি হতেন?

রাত নামার আগে আনিসা সিদ্ধান্ত নেয়—সে আবার কাজ খুঁজবে। বোনটার জন্য, নিজের জন্য।

এই শহর তাকে বারবার ভাঙছে, কিন্তু প্রতিদিন সে একটু একটু করে শক্তও হয়ে উঠছে।      চলবে----------