রাতটা একেবারেই শান্ত ছিল না। ট্রেনের কর্কশ শব্দ, মানুষের চিৎকার আর দূরের কুকুরের হাহাকার বারবার আনিসার ঘুম ভেঙে দিচ্ছিল। পাতলা কাপড়ে শরীর ঢেকে মাটির ওপর শুয়ে সে বারবার পাশ ফিরেছে। ক্ষুধা আর ক্লান্তি মিলেমিশে শরীরটা ভারী করে রেখেছে। তবু ভোরের আলো ফোটার আগেই তার চোখ খুলে গেল। জানালার ফাঁক দিয়ে ঢুকে পড়া নরম আলোয় সে বুঝল—আরেকটা দিন শুরু হয়ে গেছে। বাঁচার আরেকটা লড়াই।
আগের দিনের সেই দশ টাকার কথা তার বুকের ভেতর কাঁটার মতো বিঁধে আছে। টাকাটা ছোট, কিন্তু তার পেছনে লুকিয়ে থাকা করুণা আর অসহায়তা তাকে ভেতরে ভেতরে ভেঙে দিয়েছিল। আনিসা আর কারও দয়ার পাত্র হতে চায় না। সে জানে, দয়া মানুষকে বাঁচায় না—দয়া মানুষকে আরও ছোট করে দেয়। আজ সে ঠিক করেছে, যত কষ্টই হোক, নিজের পরিশ্রমেই দাঁড়াবে।
শহরটা তার কাছে এখনো অচেনা, নিষ্ঠুর। এখানে কেউ আপন নয়। কেউ সাহায্য করে, আবার সেই সাহায্যের আড়ালেই লুকিয়ে থাকে বিপদ। তাই প্রতিটা মানুষের চোখে তাকানোর সময় সে ভরসার চেয়ে ভয় বেশি খোঁজে। তবু ভেতরের অদম্য ইচ্ছেটা তাকে থামতে দেয় না। সে শুধু বাঁচতে নয়, মানুষ হিসেবে বাঁচতে চায়।
রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে থাকা ছোট ছোট দোকানগুলোর দিকে তাকাল আনিসা। কোথাও বিরক্তির চোখ, কোথাও অবহেলার হাসি, কোথাও আবার করুণার ছায়া। “কাজ আছে?”—এই প্রশ্নটা করতে গলা শুকিয়ে আসে তার। বারবার না শুনতে শুনতে আত্মসম্মানটা যেন ধুলোয় মিশে যাচ্ছে। তবু সে থামে না। কারণ থামলেই আবার ক্ষুধা তাকে গ্রাস করবে।
দুপুরের দিকে এক চায়ের দোকানে অস্থায়ী কাজের সুযোগ মিলল। কাপড় মুছা, জিনিস সাজানো, হালকা হিসাব রাখা—কাজগুলো তার ছোট হাতের জন্য সহজ ছিল না। তবু সে চুপচাপ সব শিখে নিল। ভুল করলে বকা পেল, কিন্তু সেই বকুনির মধ্যে অপমান ছিল না। এই সামান্য সম্মানটুকু তার চোখে জল এনে দিল। এতদিন পর কেউ তাকে শুধু “ভিখারিনির মতো” নয়, কাজের মানুষ হিসেবে দেখছে—এই অনুভূতিটা অমূল্য।
দুপুর গড়িয়ে বিকেল নামল। দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা এক অচেনা লোকের দৃষ্টি আনিসার বুক কেঁপে উঠতে বাধ্য করল। শহরের অন্ধকার দিকটা সে ইতিমধ্যেই চিনে ফেলেছে। নিজের ভয় গিলে সে মালিককে জানাল। কিছুক্ষণের মধ্যেই লোকটা সরে গেল। ছোট্ট একটা সিদ্ধান্ত, কিন্তু হয়তো আজ বড় কোনো বিপদ থেকে নিজেকে বাঁচাতে পেরেছে সে। ভয় তাকে গ্রাস করেনি—ভয়কে সে সামলেছে।
কাজ শেষে যখন হাতে মজুরির টাকা এল, আনিসা কিছুক্ষণ নড়তে পারল না। টাকাটা খুবই সামান্য। কিন্তু এটা তার নিজের ঘামে ভেজা। কারও দয়া নয়, কারও করুণা নয়। চোখের কোণে জমে ওঠা জল সে লুকিয়ে ফেলল। এই টাকাটা তার আত্মসম্মানের প্রথম ছোট্ট দলিল।
ফিরে যাওয়ার পথে বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে চারপাশের মানুষগুলোকে দেখল সে। সবাই ছুটছে—কেউ ঘরের দিকে, কেউ স্বপ্নের দিকে। আর সে? তার কোনো ঘর নেই, কিন্তু স্বপ্ন আছে। বুকের ভেতর জমে থাকা দুঃখ, বঞ্চনা আর অভাবের পাহাড়ের মাঝেও একটা ছোট আলো জ্বলছে।
রাতে শুয়ে শুয়ে আনিসা ভাবল—শহর তার অনেক কিছু কেড়ে নিয়েছে। শৈশব, নিশ্চিন্ত ঘুম, মায়ের আঁচল। তবু আজ শহর তাকে একটা শিক্ষা দিয়েছে—দায়িত্ব কাঁধে এলে মানুষ শক্ত হয়, সতর্ক হলে বেঁচে থাকা যায়, আর নিজের ওপর বিশ্বাস রাখলে সবচেয়ে অন্ধকার রাতেও একটু আলো পাওয়া যায়।
ছোট্ট আনিসা জানে, তার পথ অনেক লম্বা। কষ্ট আরও আসবে, চোখের জল আরও ঝরবে। তবু সে বেঁচে থাকতে চায় না।
সে চায়—সব দুঃখ, সব বঞ্চনাকে পেছনে ফেলে সম্মানের সঙ্গে বাঁচতে।
ছোট্ট আনিসা — পর্ব ৬
ভোরটা আজ দেরিতে এলো।
না, সূর্য দেরি করেনি—আনিসার চোখ খুলতে দেরি হলো। শরীরটা ব্যথায় শক্ত হয়ে আছে। কালকের কাজের ক্লান্তি, মাটির ঠান্ডা আর আধপেটা খাওয়া মিলিয়ে ঘুমটা ছিল ভারী, অথচ অসম্পূর্ণ। চোখ খুলেই বুকের ভেতর এক অজানা ভয় ঢুকে পড়ল—আজ যদি কাজ না থাকে?
সে উঠে বসল। চারপাশে তাকিয়ে বুঝল, এই শহরে কেউ কারও অপেক্ষায় থাকে না। আজ না গেলে আজই ভুলে যাবে সবাই। দ্রুত মুখে পানি ছিটিয়ে, ছেঁড়া কাপড়টা ঠিক করে বেরিয়ে পড়ল।
রাস্তায় বের হতেই পেটের ভেতর মোচড় দিল। ক্ষুধা এখন আর শুধু শরীরের নয়—মনে গেঁথে গেছে। তবু সে থামল না। মাথার ভেতর শুধু একটা কথা ঘুরছে—আজ কাজ না পেলে, রাতটা আরও কঠিন হবে।
চায়ের দোকানে গিয়ে মালিকের দিকে তাকাল।
লোকটা ব্যস্ত, চোখ তুলে তাকালও না।
“আজ দরকার নেই,”
এই চারটা শব্দ যেন আনিসার বুকে আঘাত করে বসাল। সে কিছু বলল না। শুধু মাথা নিচু করে সরে গেল। এই না বলাটা নতুন কিছু নয়, তবু প্রতিবারই কষ্ট দেয়।
আরও কয়েকটা দোকানে গেল। কোথাও অবহেলা, কোথাও সন্দেহ। কোথাও আবার এমন দৃষ্টি—যেন সে মানুষ নয়, বোঝা। এক জায়গায় এক লোক বলল,
“এত ছোট, কাজ পারবি?”
আনিসা উত্তর দিল না। উত্তর দিতে গেলে হয়তো কান্না বেরিয়ে আসত।
দুপুর গড়িয়ে যাচ্ছিল। রোদ মাথার ওপর আগুন ঢেলে দিচ্ছে। সে ফুটপাথের পাশে বসে পড়ল। পায়ের কাছে একটা শুকনো পাতাও যেন তার চেয়ে বেশি নিশ্চিন্ত। চোখ ঝাপসা হয়ে এলো। এই শহরে তার কেউ নেই—এই সত্যিটা হঠাৎ খুব ভারী লাগল।
ঠিক তখনই পাশের এক পুরোনো কাপড়ের দোকান থেকে একজন বৃদ্ধা মহিলা বেরিয়ে এলেন। আনিসার দিকে তাকিয়ে বলল,
“এখানে বসে আছিস কেন মা?”
এই “মা” ডাকটা আনিসার বুক কাঁপিয়ে দিল। অনেক দিন কেউ এভাবে ডাকেনি। সে ধীরে ধীরে সব বলল না, শুধু বলল, “কাজ খুঁজছি।”
বৃদ্ধা একটু চুপ করে থেকে বললেন,
“ভেতরে আয়। আজ সারাদিন না হলেও একটু সাহায্য করিস।”
এই কথাটুকুই যেন ডুবে যাওয়া মানুষকে দেওয়া এক মুঠো বাতাস। আনিসা ভেতরে ঢুকল। কাপড় গুছানো, ধুলো ঝাড়া—কাজ সহজ নয়, কিন্তু পরিচিত। কাজ করতে করতে তার চোখে পানি জমে উঠল। কষ্টের না—কৃতজ্ঞতার।
দুপুরে বৃদ্ধা তাকে অর্ধেক রুটি আর একটু তরকারি দিলেন। খুব সাধারণ খাবার, কিন্তু আনিসার কাছে তা যেন রাজকীয়। খেতে খেতে সে মাথা নিচু করে রাখল, যেন কেউ তার চোখের জল দেখতে না পায়।
বিকেলে দোকানে এক ঝামেলা হলো। এক ক্রেতা চেঁচামেচি করছিল। আনিসা চুপচাপ একপাশে দাঁড়িয়ে থাকল। শহর তাকে শিখিয়েছে—সব ঝগড়ায় জড়াতে নেই। বৃদ্ধা দূর থেকে তাকিয়ে শুধু বললেন,
“ভয় পাস না, মা। ঠিক আছিস।”
এই কথাটুকু তার বুকের ভেতর কোথাও গেঁথে রইল।
কাজ শেষে হাতে কিছু টাকা এলো। খুব বেশি নয়, তবু আজ দু’বার খাওয়ার মতো। টাকা হাতে নিয়ে আনিসা বুঝল—এই শহর তাকে বারবার ঠেলে ফেলবে, আবার কখনো কখনো তুলে ধরবেও।
রাতে শুয়ে সে আকাশের দিকে তাকাল। তারারা খুব দূরে, কিন্তু আছে। ঠিক তার স্বপ্নের মতো। বুকের ভেতরের কষ্ট, দুঃখ আর বঞ্চনা আজও আছে। কিন্তু তার সঙ্গে যোগ হয়েছে আরেকটা জিনিস—সহ্য করার শক্তি।
ছোট্ট আনিসা এখন বুঝতে শিখছে—
সব দিন একরকম হয় না।
সব মানুষ খারাপ নয়।
আর সবচেয়ে বড় কথা—
ভেঙে পড়লেই শেষ নয়, আবার উঠতে জানাটাই আসল বেঁচে থাকা।
সে চোখ বন্ধ করল।
আগামীকাল কী হবে জানে না।
তবু আজ, এই মুহূর্তে,
সে হার মানেনি। চলবে--