(অতীত, বিচ্ছেদ ও বড় হয়ে ওঠার প্রথম ব্যথা) আনিসার মাঝে মাঝে মনে হয়—তার জীবনটা যেন হঠাৎ করেই শুরু হয়নি, ধীরে ধীরে ভেঙে পড়েছে।এই শহরের কোলাহলের মাঝখানে দাঁড়িয়ে তার চোখে ভেসে ওঠে সবুজ ধানক্ষেত, কাঁচা রাস্তার ধুলো, আর একটুখানি মাটির ঘর।ওর গ্রামটা খুব বড় ছিল না। কিন্তু সেখানে ছিল মা।
মা মানে শুধু একজন মানুষ নয়—মা মানে ছিল নিরাপত্তা, ঘুমের আগে গল্প, আর ক্ষুধার সময় নিজের ভাতের অর্ধেক তুলে দেওয়া হাত।
বাবাকে সে খুব ভালো করে মনে করতে পারে না। আবছা একটা মুখ, কড়া গলার আওয়াজ, আর সন্ধ্যার পর বাড়ি ফেরার সময় মায়ের মুখে জমে ওঠা দুশ্চিন্তা। বাবা কাজের খোঁজে একদিন শহরে গিয়েছিলেন। বলেছিলেন, “কয়েক মাস পর ফিরে আসব।”
কয়েক মাস পেরিয়ে গেল, বছরও পেরিয়ে গেল।
বাবা আর ফিরে এলেন না।
মা তখন থেকেই বদলে যেতে লাগলেন। হাসিটা কমে গেল, কণ্ঠে ক্লান্তি বাড়ল। কাজের চাপে, অভাবের টানে, একদিন জ্বরে পড়ে মা শয্যাশায়ী হলেন। আনিসা তখন খুব ছোট। মায়ের কপালে হাত রেখে সে বুঝতে পারেনি—এই জ্বর শুধু শরীরের নয়, জীবনেরও।
মা চলে যাওয়ার পর পৃথিবীটা হঠাৎ ফাঁকা হয়ে গেল।
গ্রামের মানুষ প্রথমে সাহায্য করেছিল। পরে সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়ল নিজের জীবনে। আনিসা হয়ে উঠল “বোঝা”—এই শব্দটা সে তখন বুঝত না, কিন্তু চোখের ভাষা বুঝত।
এক আত্মীয়ের হাত ধরে শহরে আসা। তারপর সেই আত্মীয়ও হারিয়ে যাওয়া।
এরপর থেকে আনিসা একাই।
শহরে দিনগুলো একরকম নয়।
কখনো কাজ, কখনো না।
কখনো দু’মুঠো ভাত, কখনো শুধু পানি।
এই শহরেই আনিসা ধীরে ধীরে বড় হচ্ছে।
শুধু বয়সে নয়—চোখে, মনে, বোঝাপড়ায়।
ইদানীং সে একটা অদ্ভুত পরিবর্তন টের পাচ্ছে।
আগে মানুষ তাকে দেখত অবহেলা বা করুণার চোখে।
এখন সেই দৃষ্টি বদলাচ্ছে।
রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকলে কিছু উঠতি ছেলে তাকে দেখে গল্প জুড়ে দেয়।
হাসে, অকারণে কথা বলে, পথ আটকে দাঁড়ায়।
কেউ খুব কাছে এসে বসে পড়ে—এতটাই কাছে যে আনিসার বুক কেঁপে ওঠে।
কেউ কেউ এমন কথা বলে, যার মানে সে পুরো বোঝে না, কিন্তু বুঝে যায়—এই কথা ভালো নয়।
একদিন বাসস্ট্যান্ডে বসে থাকতেই এক ছেলে এসে বলেছিল,
“একা একা থাকিস কেন? আমার সঙ্গে থাকলে কষ্ট করতে হবে না।”
কথাটা খুব সাধারণ শোনালেও আনিসার শরীর ঠান্ডা হয়ে গিয়েছিল।
সে জানে, এই শহরে কিছু প্রস্তাব দয়া নয়—ফাঁদ।
সে উঠে চলে এসেছিল।
পেছন থেকে হাসির শব্দ এসেছিল, কটাক্ষের শব্দ।
সেদিন রাতে সে অনেকক্ষণ কেঁদেছিল। মায়ের কথা খুব মনে পড়েছিল।
মা থাকলে কি কেউ তাকে এভাবে তাকাতে সাহস পেত?
আনিসা এখন সাবধান হতে শিখছে।
হাসি কমিয়ে দিয়েছে।
চোখ নামিয়ে হাঁটে।
ভিড় এড়িয়ে চলে।
রাতে একা বের হয় না।
সে বুঝে গেছে—বড় হওয়া মানে শুধু শক্ত হওয়া নয়, সতর্ক হওয়াও।
কিছু মানুষ তাকে সাহায্য করে, কিন্তু সে এখন আর অন্ধভাবে বিশ্বাস করে না।
প্রতিটা ভালো কথার পেছনে সে প্রশ্ন খোঁজে—এর দাম কী?
তবু আনিসা হার মানেনি।
এই সব অভিজ্ঞতা তাকে ভেঙে দেয়নি, বরং ভিতরে ভিতরে শক্ত করেছে।
মায়ের শেখানো একটা কথা সে মনে রাখে—
“মাথা নিচু করে বাঁচিস না, কিন্তু সাবধানে বাঁচিস।”
আজ আনিসা জানে, তার শরীর এখন আর শুধু তার নিজের কাছে গুরুত্বপূর্ণ নয়—এই শহরের অনেক চোখ সেখানে অধিকার খোঁজে।
এই উপলব্ধিটা কষ্টের, লজ্জার, কিন্তু বাস্তব।
রাতে শুয়ে সে আকাশের দিকে তাকায়।
তারারা দেখে মনে হয়—সব আলো কাছ থেকে আসে না, কিছু আলো দূর থেকেই পথ দেখায়।
মায়ের মুখটা মনে পড়ে।
গ্রামের সেই উঠোন।
সব হারিয়ে গেলেও একটা জিনিস তার আছে—নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার ইচ্ছা।
ছোট্ট আনিসা এখন আর শুধু শিশু নয়।
সে ধীরে ধীরে একজন কিশোরীতে পরিণত হচ্ছে—
কষ্টের ভেতর দিয়ে, অভাবের ভেতর দিয়ে,
কিন্তু নিজের সম্মান বুকে শক্ত করে ধরে।
তার পথ কঠিন।
বিপদ সামনে।
তবু সে হাঁটছে।
কারণ সে জানে—
হার মানলেই এই শহর তাকে গ্রাস করবে।
আর আনিসা গ্রাস হতে শেখেনি।
সে শিখছে—বেঁচে থাকতে।
ছোট্ট আনিসা — পর্ব-৮
(ভয়, আত্মরক্ষা ও নীরব সহানুভূতি)
রাত নামলেই আনিসার বুকটা কেমন ভারী হয়ে আসে।
দিনের আলোয় শহর যতটা কোলাহলময়, রাতের অন্ধকারে ততটাই ভীতিকর। চারপাশে সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়ে—ফুটপাথ, বাসস্ট্যান্ড, পুরোনো দোকানের বারান্দা—ঠিক তখনই কিছু চোখ জেগে ওঠে। সেই চোখগুলো ঘুমায় না, স্বপ্ন দেখে না—শুধু সুযোগ খোঁজে।
প্রায় রাতেই এমন হতো।
কয়েকটা যুবক আশপাশে ঘোরাঘুরি করত। কখনো ফিসফিস করে কথা, কখনো চাপা হাসি। কখনো দূর থেকে তাকিয়ে থাকা, আবার কখনো খুব কাছে এসে দাঁড়ানো। তারা হয়তো ভাবত—একা একটা মেয়ে, গরিব, আশ্রয়হীন—তার ভয় পাওয়ার কেউ নেই।
আনিসা ভয় পেত।
ভয় না পাওয়ার মতো শক্ত সে এখনো হয়নি।
কিন্তু ভয়কে সে প্রকাশ করত না।
সে শিখে ফেলেছিল নিজের মতো করে বাঁচার কৌশল।
রাতে কখনো একা একা এক জায়গায় থাকত না।
যেখানে দু-একজন মহিলা থাকে, সেখানেই গিয়ে বসত।
কিছুটা দূরে আলো আছে—এমন জায়গা বেছে নিত।
কেউ বেশি কাছে এলে সে চুপ করে থাকত না—গলা শক্ত করে বলত, “যাও এখান থেকে।”
এই সাহসটা সহজে আসেনি।
কয়েকটা রাত কেঁদে, কয়েকটা রাত না ঘুমিয়ে, নিজের ভেতরের ভয়কে বুঝে বুঝে সে এই শক্তিটুকু তৈরি করেছে।
এক রাতে ঘটনা একটু বেশি দূর গড়াল।
তিনজন যুবক এসে খুব কাছাকাছি বসে পড়ল। কথা বলার ভঙ্গি ভালো ছিল না। আনিসার শরীর ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছিল। চারপাশে তখন প্রায় সবাই ঘুমিয়ে। সাহায্য চাওয়ার মতো কাউকে দেখা যাচ্ছিল না।
সে তখন মায়ের কথা মনে করল।
মা বলতেন, “ভয় পেলে গলা শক্ত করিস, চোখ তুলে তাকাস।”
আনিসা তাই করল।
সে উঠে দাঁড়িয়ে জোরে বলল,
“এখান থেকে চলে যাও। না হলে আমি চিৎকার করব।”
তার গলার সেই দৃঢ়তা যুবকদের একটু থামিয়ে দিল।
তারা কিছু কথা বলে সরে গেল, কিন্তু যাওয়ার সময়ও চোখে ছিল কটাক্ষ।
সেদিন রাতে আনিসা অনেকক্ষণ জেগে ছিল।
তার শরীর কাঁপছিল, কিন্তু মন বলছিল—আজ সে হেরেছে না।
পরদিন সন্ধ্যার দিকে সে আবার সেই পরিচিত জায়গাটায় বসেছিল। আকাশে তখন সন্ধ্যার আলো। ঠিক তখনই সে খেয়াল করল—কিছুটা দূরে একজন যুবক দাঁড়িয়ে আছে। বয়স খুব বেশি না, চেহারায় কোনো অস্বস্তিকর দৃষ্টি নেই। সে আনিসার দিকে তাকাচ্ছিল না, বরং আশপাশে নজর রাখছিল।
প্রথমে আনিসা সাবধান হলো।
এই শহর তাকে শিখিয়েছে—সহানুভূতির মুখোশ অনেক সময় বিপদের আড়াল।
কিন্তু কয়েক রাত ধরে সে লক্ষ্য করল—যখনই সেই আগের যুবকগুলো আশপাশে আসে, এই নতুন যুবকটা একটু কাছে চলে আসে। কিছু বলে না, কিছু করে না—শুধু দাঁড়িয়ে থাকে। তার উপস্থিতিটুকুই যেন একটা অদৃশ্য দেয়াল।
একদিন আনিসা নিজেই জিজ্ঞেস করল,
“তুমি এখানে কেন দাঁড়াও?”
যুবকটা একটু থমকাল। তারপর শান্ত গলায় বলল,
“এখানে রাতে সমস্যা হয়। আমি কাছেই থাকি। তাই… দেখি আর কী।”
এই “দেখি” শব্দটার ভেতর কোনো দাবি ছিল না, কোনো শর্ত ছিল না।
শুধু দায়িত্ববোধ।
সেই রাতে আনিসা প্রথমবার একটু নিশ্চিন্তে শ্বাস নিল।
সে জানে—এই যুবক তার অভিভাবক নয়, রক্ষাকর্তাও নয়।
কিন্তু এই শহরের অন্ধকারে কেউ একজন যদি নীরবে পাশে দাঁড়ায়—তাতেই অনেকটা আলো জ্বলে ওঠে।
আনিসা এখনও ভয় পায়।
কষ্ট এখনও আছে।
বিপদ পুরোপুরি দূরে যায়নি।
কিন্তু সে এখন একা নয়—এই বিশ্বাসটা তার বুকের ভেতর একটু শক্ত জমি তৈরি করেছে।
রাতে শুয়ে সে আকাশের দিকে তাকায়।
মায়ের মুখ মনে পড়ে।
আর মনে হয়—এই শহর যতই নিষ্ঠুর হোক, মানুষের ভেতর মানুষ এখনও পুরোপুরি মরে যায়নি।
ছোট্ট আনিসা জানে—
নিজেকে বাঁচাতে হলে তাকে সতর্ক থাকতে হবে।
কারও ওপর পুরোপুরি ভরসা নয়।
কিন্তু প্রয়োজন হলে সাহায্য নিতে ভয়ও নয়।
সে ধীরে ধীরে শিখছে—
ভয়কে চিনতে,
নিজেকে রক্ষা করতে,
আর মানুষের ভিড়ের মাঝেও নিজের সম্মান আগলে রাখতে।
তার লড়াই এখনও শেষ হয়নি।
কিন্তু সে এখন আর কেবল বেঁচে থাকা মেয়ে নয়—
সে একজন যোদ্ধা।
নীরব, ক্ষুদ্র, কিন্তু অদম্য। চলবে------------