ঢাকা, শুক্রবার, ১৯ ডিসেম্বর ২০২৫,
সময়: ১১:২৩:০২ PM

উপন্যাস: ছোট্ট আনিসা,পর্ব – ৯ ও ১০

মান্নান মারুফ
19-12-2025 08:47:35 PM
উপন্যাস: ছোট্ট আনিসা,পর্ব – ৯ ও ১০

সময় থেমে থাকে না। ছোট্ট আনিসাও আর ছোট্ট নেই। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তার চেহারায় এসেছে এক ধরনের স্বাভাবিক কোমলতা। গোলগাল মুখে লাজুক হাসি, চোখে অনাবিল সরলতা—সব মিলিয়ে সে যেন অজান্তেই অনেকের দৃষ্টি কাড়তে শুরু করেছে। তবে আনিসা এসব কিছুই বুঝত না। সে যেমন ছিল, এখনও তেমনই—নিজের জগতে ডুবে থাকা, অল্পতেই খুশি হওয়া এক কিশোরী।

এই বদলে যাওয়া সময়ের মাঝেই একজন মানুষ ছিল, যে নীরবে সবকিছু লক্ষ করত। সে যুবকটি সবসময় আনিসার আশেপাশেই থাকত, কিন্তু কখনো নিজের উপস্থিতি জাহির করত না। প্রয়োজন হলে সাহায্য করত, বিপদে পড়লে আগলে রাখত। তার আচরণে ছিল দায়িত্ববোধ, ছিল নিঃস্বার্থতা। আনিসা কখনো বুঝতে পারেনি কেন লোকটি তাকে নিয়ে এতটা সতর্ক থাকে, কেন সে সবসময় দূর থেকে নজর রাখে।

একদিন হঠাৎ করেই আনিসার মনে কৌতূহল জাগল। এতদিন ধরে যে মানুষটি তার পাশে আছে, তার নামটুকুও তো জানা হয়নি। সেদিন সাহস করে সে জিজ্ঞেস করল,
— “আপনার নাম কী?”

যুবকটি একটু থমকে গেল। যেন প্রশ্নটার জন্য প্রস্তুত ছিল না। তারপর হালকা হাসি দিয়ে বলল,
— “আমার নাম রতন।”

এই নামটি যেন আনিসার মনে কোথাও গেঁথে গেল। রতন—সাধারণ একটি নাম, অথচ তার ভেতরে কেমন যেন এক ধরনের ভরসা ছিল। সেদিনের পর থেকে আনিসা আর তাকে ‘ওই যুবক’ বলে ভাবেনি, তার মনে সে হয়ে উঠল রতন।

দিন যেতে লাগল। রতন মাঝেমধ্যে আনিসাকে নানা কাজে সাহায্য করত—কখনো বই জোগাড় করে দিত, কখনো কোনো কাজ বুঝিয়ে দিত। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, এর বিনিময়ে সে কখনো কিছু চাইত না। না কৃতজ্ঞতা, না কোনো প্রতিদান। তার আচরণে ছিল এক ধরনের নীরব সম্মান।

আনিসার জীবনেও ধীরে ধীরে পরিবর্তন আসছিল। সে বুঝতে পারছিল, রতন পাশে থাকলে তার মনটা অদ্ভুতভাবে শান্ত থাকে। কোনো ভয় থাকলে তা কমে যায়। আবার রতনও খেয়াল করত, আনিসার মুখে হাসি দেখলে তার নিজের মনটা হালকা হয়ে যায়। অথচ তারা কেউই কখনো নিজেদের অনুভূতির নাম দেয়নি।

এইভাবেই চলতে চলতে একসময় এমন অবস্থা হলো, আনিসা আর রতন একে অপরকে ছাড়া নিজেদের কল্পনাই করতে পারত না। কথা না হলেও চোখের এক ঝলক দেখাই যেন যথেষ্ট ছিল। কখনো আলাদা হলে মনে হতো, কিছু একটা অসম্পূর্ণ থেকে যাচ্ছে।

তাদের এই সম্পর্কের কোনো নাম ছিল না। না ছিল কোনো প্রকাশ্য স্বীকারোক্তি। তবু অদৃশ্য এক বন্ধনে তারা জড়িয়ে পড়েছিল। এমন এক বন্ধন, যা তারা নিজেরাও পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারেনি। এটি ভালোবাসা কি না, তা জানার বয়স বা সাহস—কোনোটাই তাদের ছিল না। শুধু এটুকু বোঝা যেত, তারা একে অপরের জন্য আলাদা হয়ে উঠেছে।

কখনো আনিসা রাতে ঘুমানোর আগে ভাবত, সারাদিনে রতনের সঙ্গে দেখা না হলে কেন মনটা খারাপ লাগে। আবার রতনও ভাবত, আনিসা নিরাপদ আছে কি না—এই চিন্তা কেন তাকে এত ব্যস্ত করে রাখে। এসব প্রশ্নের কোনো উত্তর তারা খুঁজত না। সময় যেমন চলছিল, তারাও তেমনই ভেসে যাচ্ছিল।

এই অদৃশ্য ভালোবাসা ছিল নিষ্পাপ, ছিল নিঃশব্দ। কোনো দাবি ছিল না, ছিল না কোনো প্রত্যাশা। শুধু ছিল একে অপরের পাশে থাকার অদম্য ইচ্ছা। হয়তো ভবিষ্যৎ তাদের জন্য কী অপেক্ষা করছে, তা কেউ জানত না। কিন্তু এই মুহূর্তে, এই সময়ে—আনিসা আর রতনের জীবন এক সুতোয় বাঁধা পড়ে গেছে, অজান্তেই।

 

পর্ব – ১০

সময় আরও একটু এগিয়ে গেল। ঋতু বদলাল, চারপাশের প্রকৃতি যেমন বদলায়, তেমনি বদলাতে লাগল আনিসার মনও। আগের মতো সে আর সবকিছুতে উদাসীন থাকতে পারত না। ছোট ছোট ঘটনায় সে বেশি ভাবতে শুরু করল। বিশেষ করে রতনকে ঘিরে তার ভাবনাগুলো যেন আলাদা হয়ে উঠছিল।

আগে রতন না এলে আনিসার তেমন কিছু মনে হতো না। এখন দিন শেষে তার চোখ অজান্তেই খুঁজে বেড়াত পরিচিত সেই মুখটিকে। যদি কোনোদিন রতন না আসত, আনিসার মনটা ভার হয়ে থাকত। সে নিজেই বুঝতে পারত না, কেন এমন হচ্ছে। নিজেকে বোঝানোর চেষ্টা করত—এটা হয়তো কৃতজ্ঞতা, হয়তো অভ্যাস। কিন্তু মন কি আর সহজে বোঝে?

রতনের অবস্থাও আলাদা ছিল না। সে আগের মতোই সংযত, আগের মতোই নীরব। কিন্তু তার চোখে এখন এক ধরনের দুশ্চিন্তা লুকিয়ে থাকত। আনিসা বড় হচ্ছে—এই বাস্তবতা তাকে ভাবিয়ে তুলছিল। চারপাশের দৃষ্টি, মানুষের ফিসফাস, সবকিছুই তার অজানা ছিল না। তাই আগের চেয়েও বেশি সাবধান হয়ে উঠেছিল সে।

একদিন বিকেলের দিকে আনিসা একা বসে ছিল। আকাশে মেঘ জমছিল, হালকা বাতাস বইছিল। হঠাৎ রতন এসে দাঁড়াল পাশে।
— “আজ একা বসে আছো?”
আনিসা মাথা নেড়ে বলল,
— “হ্যাঁ।”

কিছুক্ষণ নীরবতা। এই নীরবতাই যেন তাদের সবচেয়ে পরিচিত ভাষা। তারপর রতন ধীরে বলল,
— “তুমি এখন অনেক বদলে যাচ্ছ।”

আনিসা একটু অবাক হলো।
— “কীভাবে?”

রতন সরাসরি তাকাল না। দূরের দিকে তাকিয়ে বলল,
— “আগের সেই ছোট্ট আনিসা আর নেই। এখন তুমি বুঝতে শেখছ, ভাবতে শেখছ।”

এই কথাগুলো আনিসার মনে কেমন একটা আলোড়ন তুলল। সে বুঝতে পারল, রতন তাকে শুধু দেখেই নয়, গভীরভাবে লক্ষ্যও করে। এই অনুভূতিটা তাকে লজ্জা দিল, আবার ভালোও লাগল।

সেদিন তারা বেশি কথা বলেনি। কিন্তু আলাদা হওয়ার সময় আনিসার মনে হলো, আজকের এই অল্প কথাগুলো অনেক গভীর কিছু বলে গেল। সে প্রথমবারের মতো বুঝতে পারল, রতনের উপস্থিতি তার জীবনে কতটা গুরুত্বপূর্ণ।

রাতে ঘুমোতে যাওয়ার আগে আনিসা অনেকক্ষণ জেগে থাকল। তার মনে নানা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছিল। রতন কি শুধু একজন অভিভাবকের মতো, নাকি তার চেয়েও বেশি কিছু? প্রশ্নগুলোর উত্তর সে খুঁজতে সাহস পেল না। শুধু এটুকু জানত—রতনকে ছাড়া তার দিনগুলো কল্পনা করা কঠিন হয়ে পড়ছে।

অন্যদিকে, রতনও নিজের সঙ্গে লড়াই করছিল। সে জানত, অনুভূতিগুলোকে নাম দেওয়া সহজ নয়, আবার সব অনুভূতি প্রকাশ করাও ঠিক নয়। সে শুধু চাইত, আনিসা যেন নিরাপদ থাকে, ভালো থাকে। নিজের অনুভূতিকে সে নিজের ভেতরেই বেঁধে রাখল।

এই সময়েই তাদের জীবনে ধীরে ধীরে এক ধরনের দূরত্বও আসতে শুরু করল। ইচ্ছাকৃত নয়, পরিস্থিতির কারণে। রতন আগের মতো সবসময় কাছে থাকতে পারত না। আনিসা সেটা বুঝত, তবু তার মন মানতে চাইত না। এই প্রথম সে অপেক্ষার কষ্ট বুঝল।

তবুও তাদের সম্পর্ক ভাঙেনি। বরং নীরবতার ভেতর দিয়ে আরও শক্ত হয়ে উঠছিল। কোনো কথা না বলেও তারা একে অপরকে অনুভব করতে পারত। চোখের ভাষা, উপস্থিতির উষ্ণতা—সব মিলিয়ে তাদের বন্ধন ছিল নিঃশব্দ কিন্তু গভীর।

চলবে------