ঢাকা, মঙ্গলবার, ৩০ ডিসেম্বর ২০২৬,
সময়: ০৩:৪৭:১৩ PM

বেগম খালেদা জিয়ার বর্ণাঢ্য জীবনের চিত্র

ষ্টাফ রিপোটার।। দৈনিক সমবাংলা
30-12-2025 11:13:19 AM
বেগম খালেদা জিয়ার বর্ণাঢ্য জীবনের চিত্র

বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)-এর চেয়ারপারসন ও তিনবারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া আর নেই (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। মঙ্গলবার (৩০ ডিসেম্বর) ভোর ৬টায় রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি ইন্তেকাল করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৮০ বছর। তার মৃত্যুতে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে নেমে এসেছে গভীর শোক। দীর্ঘ পাঁচ দশকের রাজনৈতিক জীবনে তিনি ছিলেন বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের অন্যতম প্রধান প্রতীক।

জন্ম ও পারিবারিক জীবন

বেগম খালেদা জিয়া ১৯৪৬ সালের ১৫ আগস্ট দিনাজপুর জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা ইস্কান্দার মজুমদার ও মা তৈয়বা মজুমদার। দেশ বিভাগের পর তার বাবা ভারতের জলপাইগুড়ি থেকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে চলে আসেন। পারিবারিকভাবে তাদের আদি বাড়ি ফেনী জেলায়।

তিনি দিনাজপুর সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা সম্পন্ন করেন এবং পরে ঢাকার সুরেন্দ্রনাথ কলেজে অধ্যয়ন করেন।

১৯৬০ সালে তিনি তৎকালীন সেনা কর্মকর্তা, পরবর্তীতে স্বাধীনতার ঘোষক ও রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। এই দাম্পত্য জীবন থেকেই তার ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক জীবনের পথ রচিত হয়।

রাজনীতিতে পদার্পণ

১৯৮১ সালের ৩০ মে এক ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান শাহাদাত বরণ করলে বেগম খালেদা জিয়ার জীবন আমূল বদলে যায়। শোককে শক্তিতে রূপান্তর করে তিনি রাজনীতিতে সক্রিয় হন।

১৯৮২ সালের ২ জানুয়ারি তিনি বিএনপির সাধারণ সদস্য হিসেবে দলে যোগ দেন। ১৯৮৩ সালের মার্চে ভাইস-চেয়ারম্যান এবং ১৯৮৪ সালের আগস্টে দলের চেয়ারপারসন নির্বাচিত হন।

এরশাদবিরোধী আন্দোলন ও ‘আপোষহীন নেত্রী’

১৯৮২ সালে জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের সামরিক অভ্যুত্থানের পর বেগম খালেদা জিয়া গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। ১৯৮৩ সালে গঠিত সাত দলীয় জোটের অন্যতম স্থপতি ছিলেন তিনি।

১৯৮৬ সালের কারচুপিপূর্ণ নির্বাচনের বিরোধিতা করে তিনি নির্বাচনে অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকেন, যদিও তৎকালীন অনেক রাজনৈতিক দল সেই নির্বাচনে অংশ নেয়। এরশাদবিরোধী আন্দোলনে তার দৃঢ় অবস্থানের কারণে ১৯৮৩ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত তাকে সাতবার গ্রেপ্তার করা হয়।

এই সময় তিনি বিএনপির ছাত্র সংগঠন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলকে একটি শক্তিশালী সংগঠনে রূপ দেন। এরশাদবিরোধী আন্দোলনে ছাত্রদল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সামরিক স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে অনড় অবস্থানের কারণেই তিনি ‘আপোষহীন নেত্রী’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন।

প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী

১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে বেগম খালেদা জিয়া বাংলাদেশের ইতিহাসের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হন। তার নেতৃত্বে রাষ্ট্রপতি শাসিত ব্যবস্থা বিলুপ্ত হয়ে দেশে সংসদীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়।

তার প্রথম মেয়াদে অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আসে। কর্মসংস্থান উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পায়। বিশেষ করে তৈরি পোশাকশিল্প খাতে পাঁচ বছরে কর্মসংস্থান প্রায় ২৯ শতাংশ বৃদ্ধি পায়, যেখানে প্রায় দুই লাখ নারী নতুনভাবে যুক্ত হন।

আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ভূমিকা

প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে তিনি জাতিসংঘে গঙ্গার পানি বণ্টনের ন্যায্য হিস্যা নিয়ে বাংলাদেশের দাবি তুলে ধরেন। ১৯৯২ সালে হোয়াইট হাউসে আমন্ত্রিত হয়ে তিনি রোহিঙ্গা মুসলিম শরণার্থীদের বিষয়টি আন্তর্জাতিকভাবে উত্থাপন করেন। এর ফলশ্রুতিতে ১৯৯০-এর দশকের শুরুতে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে মিয়ানমারের সঙ্গে একটি চুক্তি হয়।

দ্বিতীয় ও তৃতীয় মেয়াদ

১৯৯৬ সালে বিএনপি সংসদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলেও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে এক মাসের মধ্যে তিনি পদত্যাগ করেন। জুনের নির্বাচনে বিএনপি পরাজিত হলেও সংসদে ১১৬ আসন পেয়ে ইতিহাসের সবচেয়ে বড় বিরোধী দলে পরিণত হয়।

১৯৯৯ সালে তার নেতৃত্বে চারদলীয় জোট গঠিত হয়। দুর্নীতি ও সন্ত্রাস নির্মূলের অঙ্গীকার নিয়ে ২০০১ সালের নির্বাচনে জয়ী হয়ে তিনি তৃতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী হন।

নারী শিক্ষা ও ক্ষমতায়নে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ফোর্বস ম্যাগাজিন ২০০৫ সালে বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর নারীদের তালিকায় তাকে ২৯তম স্থানে স্থান দেয়।

কারাবাস ও অসুস্থতা

২০০৬ সালে তিনি শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। ২০০৭ সালে সেনা–সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। ২০০৮ সালের নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে তিনি বিরোধীদলীয় নেতার দায়িত্ব পালন করেন।

২০১৮ সালে কথিত দুর্নীতির মামলায় তাকে কারাগারে পাঠানো হয়। কারাবাসের সময় তার শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটে। ২০২০ সালে করোনা মহামারির সময় শর্তসাপেক্ষে তাকে বাসায় থাকার অনুমতি দেওয়া হয়।

উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে নেওয়ার প্রয়োজন হলেও সে অনুমতি দীর্ঘদিন দেওয়া হয়নি। ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর তিনি চিকিৎসার জন্য লন্ডনে যান। দেশে ফিরে আবারও অসুস্থ হয়ে পড়লে ২০২৫ সালের ২৩ নভেম্বর তাকে এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

শিক্ষা ও সামাজিক উন্নয়নে অবদান

তার শাসনামলে বাধ্যতামূলক বিনামূল্যে প্রাথমিক শিক্ষা, মেয়েদের জন্য দশম শ্রেণি পর্যন্ত বিনামূল্যে শিক্ষা, ছাত্রীদের উপবৃত্তি ও ‘খাদ্যের বিনিময়ে শিক্ষা’ কর্মসূচি চালু হয়। সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ২৭ থেকে বাড়িয়ে ৩০ বছর করা হয় এবং শিক্ষা খাতে সর্বোচ্চ বাজেট বরাদ্দ দেওয়া হয়।

নির্বাচনী রেকর্ড

দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে তিনি যে কোনো আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে পরাজিত হননি। ১৯৯১ থেকে ২০০১ সালের নির্বাচনে পাঁচটি ভিন্ন আসনে এবং ২০০৮ সালের নির্বাচনে তিনটি আসনেই তিনি বিজয়ী হন।

অবসান

বেগম খালেদা জিয়ার মৃত্যুতে বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক যুগের অবসান হলো। সংগ্রাম, নেতৃত্ব ও আত্মত্যাগে ভরপুর তার জীবন ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।