ঢাকা, সোমবার, ২৭ অক্টোবর ২০২৫,
সময়: ১২:৩৪:৪৯ AM

প্রথম দফায় বিএনপির ‘গ্রিন সিগন্যাল’ পেলেন যারা

ষ্টাফ রিপোটার।। দৈনিক সমবাংলা
26-10-2025 08:39:50 PM
প্রথম দফায় বিএনপির ‘গ্রিন সিগন্যাল’ পেলেন যারা

আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) এখন এক গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে অবস্থান করছে। নির্বাচনী আনুষ্ঠানিকতা শুরু না হলেও, দলের অভ্যন্তরে চলছে নিবিড় প্রস্তুতি—যার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছেন দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। লন্ডন থেকে তিনি সরাসরি তত্ত্বাবধান করছেন সম্ভাব্য প্রার্থীদের মনোনয়ন প্রক্রিয়া। তারেক রহমানের একটি ফোন কলই নির্ধারণ করে দিচ্ছে, কে হচ্ছেন বিএনপির কাঙ্ক্ষিত প্রার্থী। এই ফোন কলের মাধ্যমেই স্পষ্ট হচ্ছে, কে পাচ্ছেন ‘গ্রিন সিগন্যাল’ আর কে বাদ পড়ছেন নির্বাচনী দৌড় থেকে। দলীয় সূত্রে জানা গেছে, বিএনপি বর্তমানে মনোনয়ন যাচাই–বাছাইয়ের চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। প্রতিটি আসনে প্রার্থীর জনপ্রিয়তা, গ্রহণযোগ্যতা এবং সাংগঠনিক সক্ষমতা তিনি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন। শুধু পর্যবেক্ষণ নয়, সম্ভাব্য প্রার্থীদের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে একাধিকবার কথা বলেছেন তিনি। এবার তিনি যাদের নির্বাচনে অংশ নিতে নির্দেশ দিচ্ছেন, তারাই কার্যত চূড়ান্ত মনোনয়ন পাচ্ছেন।

দলীয় একাধিক সূত্রের তথ্যমতে, এবারের মনোনয়ন প্রক্রিয়া অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় ভিন্নভাবে পরিচালিত হচ্ছে। প্রার্থী নির্বাচনে তারেক রহমানের সরাসরি সম্পৃক্ততা নজিরবিহীন। তিনি কেবল নাম অনুমোদন দিচ্ছেন না, বরং নিজস্ব নেটওয়ার্কের মাধ্যমে মাঠপর্যায়ে প্রার্থীদের সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড, জনপ্রিয়তা ও জনগণের প্রতিক্রিয়া যাচাই করছেন। অনেক ক্ষেত্রেই তিনি স্থানীয় নেতাদের পাশ কাটিয়ে সরাসরি তৃণমূল নেতাদের সঙ্গেও কথা বলেছেন, যা প্রার্থী বাছাইয়ে নতুন মাত্রা যোগ করেছে।

বিএনপির এক জ্যেষ্ঠ নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন,

“আগের মতো এবার শুধু সিনিয়রিটি বা কেন্দ্রীয় সম্পর্ক নয়; মাঠের বাস্তবতা ও জনগণের পছন্দই সবচেয়ে গুরুত্ব পাচ্ছে। তারেক রহমানের কাছে এখন প্রতিটি আসনের বিস্তারিত রিপোর্ট রয়েছে। যাদের সম্পর্কে ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া এসেছে এবং যারা জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য বলে প্রমাণিত হয়েছেন, তারাই এই কাঙ্ক্ষিত ফোন কল পাচ্ছেন।”

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এই নতুন প্রক্রিয়া দলের সাংগঠনিক কাঠামোতে এক নতুন গতিশীলতা আনবে।

প্রার্থী চূড়ান্ত করার বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন,

“এই মাসের মধ্যেই দলের পক্ষ থেকে দুই শতাধিক আসনে একক প্রার্থীকে ‘গ্রিন সিগন্যাল’ দেওয়া হবে। আমরা প্রক্রিয়ার শেষ পর্যায়ে আছি। শিগগিরই সবাইকে জানানো হবে, যাতে তারা নির্বাচনী প্রস্তুতি শুরু করতে পারেন।”

ইতোমধ্যে রাজধানীর বেশ কয়েকটি আসনের সম্ভাব্য প্রার্থীরা তারেক রহমানের ফোন পেয়েছেন। তাদের কেউ কেউ ইতিমধ্যে প্রচারণার প্রস্তুতিও শুরু করেছেন। দলীয় সূত্র বলছে, ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ আসনগুলোতে তরুণ, পেশাজীবী ও রাজনৈতিকভাবে পরিচিত মুখদের অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে—যা তরুণ ভোটারদের আকৃষ্ট করার একটি কৌশল হিসেবে দেখা হচ্ছে।

এখন পর্যন্ত পাওয়া তথ্যানুসারে,

  • ঢাকা-৩: গয়েশ্বর চন্দ্র রায়

  • ঢাকা-৪: তানভীর আহমেদ রবিন

  • ঢাকা-৬: ইশরাক হোসেন

  • ঢাকা-৮: মির্জা আব্বাস

  • ঢাকা-১০: ব্যারিস্টার নাছির উদ্দিন আহমেদ অসীম

  • ঢাকা-১২: হাবিব উন নবী সোহেল

  • ঢাকা-১৩: ববি হাজ্জাজ (এনডিএম চেয়ারম্যান)

  • ঢাকা-১৫: মামুন হাসান

  • ঢাকা-১৬: আমিনুল হক

— এরা মনোনয়নের জন্য ‘গ্রিন সিগন্যাল’ পেয়েছেন বলে জানা গেছে।

সবচেয়ে আলোচিত নামগুলোর একটি হলো সানজিদা ইসলাম তুলি, ‘মায়ের ডাক’ আন্দোলনের সমন্বয়কারী এবং গুম হওয়া বিএনপি নেতা সাজেদুল ইসলাম সুমনের বোন। তিনি ঢাকা-১৪ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য তারেক রহমানের কাছ থেকে ‘গ্রিন সিগন্যাল’ পেয়েছেন।

অন্যদিকে ঢাকা-১৭ আসনটি শরিক দল বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (বিজেপি)-এর সভাপতি ব্যারিস্টার আন্দালিব রহমান পার্থকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। বিশ্লেষকদের মতে, এটি জোট রাজনীতিতে বিএনপির নমনীয়তা ও কৌশলগত বিচক্ষণতার ইঙ্গিত বহন করছে।

শুধু ঢাকাই নয়, সারাদেশেই ধীরে ধীরে চূড়ান্ত প্রার্থী তালিকা তৈরি হচ্ছে। হাইকমান্ড–সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে, অন্তত ৬০টি আসনে প্রার্থী নিয়ে কোনো মতভেদ নেই; এগুলোকে ‘নির্ভরযোগ্য’ বা ‘নিরাপদ আসন’ হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে।

এই তালিকায় আছেন শীর্ষস্থানীয় নেতারা—
ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন (কুমিল্লা–১), মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর (ঠাকুরগাঁও–১), ড. আব্দুল মঈন খান (নরসিংদী–২), ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু (সিরাজগঞ্জ–২), সালাহউদ্দিন আহমদ (কক্সবাজার–১), মেজর (অব.) হাফিজউদ্দিন আহমেদ (ভোলা–৩), বরকতউল্লাহ বুলু (নোয়াখালী–৩), মো. শাহজাহান (নোয়াখালী–৪), শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানি (লক্ষ্মীপুর–৩), মিয়া নুরউদ্দিন অপু (শরীয়তপুর–৩), আসাদুল হাবিব দুলু (লালমনিরহাট–৩), অনিন্দ্য ইসলাম অমিত (যশোর–৩), রশিদুজ্জামান মিল্লাত (জামালপুর–১), ব্যারিস্টার কায়সার কামাল (নেত্রকোনা–১), মাহমুদ হাসান খান (চুয়াডাঙ্গা–২), ফজলুল হক মিলন (গাজীপুর–৫), আমিরুল ইসলাম খান আলীম (সিরাজগঞ্জ–৫), লুৎফুজ্জামান বাবর (নেত্রকোনা–৪), ব্যারিস্টার মুহম্মদ নওশাদ জমির (পঞ্চগড়–১), সাইফুল ইসলাম ফিরোজ (ঝিনাইদহ–৪)।

গত ১৯ অক্টোবর সিলেট বিভাগের চার জেলার মনোনয়নপ্রত্যাশীদের সঙ্গে গুলশান কার্যালয়ে বৈঠক করেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। সেখানে মনোনয়ন, নির্বাচনী প্রস্তুতি ও মাঠপর্যায়ের সংগঠন নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। শিগগিরই একক প্রার্থীদের ‘গ্রিন সিগন্যাল’ দেওয়ার নির্দেশও দেওয়া হয়। এর আগে চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, রংপুর ও বরিশাল বিভাগের সঙ্গেও অনুরূপ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে।

মনোনয়ন প্রক্রিয়া সম্পর্কে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন,

“যারা এলাকায় সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য ও জনপ্রিয়, তারাই মনোনয়ন পাবেন। একই আসনে একাধিক প্রার্থী থাকলেও তাদের যোগ্যতা ও জনপ্রিয়তার তুলনামূলক বিশ্লেষণ করা হয়েছে। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান নিজেই এসব তথ্য যাচাই করেছেন। শিগগিরই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানানো হবে।”

দলীয় হাইকমান্ড থেকে স্পষ্ট নির্দেশ দেওয়া হয়েছে—যাকে ‘গ্রিন সিগন্যাল’ দেওয়া হবে, সবাইকে তার পক্ষেই কাজ করতে হবে। কোনো বিভক্তি বা কোন্দল বরদাস্ত করা হবে না; বরং বিরোধে জড়িতদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এই কঠোর অবস্থান দলের ঐক্য সুসংহত করতে সহায়ক হবে। অতীতে স্থানীয় কোন্দল অনেক সময় বিএনপির নির্বাচনী সম্ভাবনাকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে, তাই এবার হাইকমান্ড বিশেষভাবে সতর্ক।

বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বিএনপির এই মনোনয়ন প্রক্রিয়া অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। শক্তিশালী ও জনপ্রিয় প্রার্থী বাছাই এখন দলের জন্য অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। তারেক রহমানের সরাসরি সম্পৃক্ততা যেমন দলের ওপর তার নিয়ন্ত্রণকে মজবুত করছে, তেমনি যোগ্য প্রার্থী নির্ধারণেও সহায়ক হচ্ছে।

জোট রাজনীতির ক্ষেত্রেও বিএনপি এবার কৌশলগত ভারসাম্য রক্ষা করতে চাইছে। দীর্ঘদিনের শরিকদের পাশাপাশি নতুন কিছু দলকেও সঙ্গে নিয়ে আসন ভাগাভাগির আলোচনা চলছে। এ প্রসঙ্গে ২৪ অক্টোবর স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন,

“নির্বাচনকে সামনে রেখে বিভিন্ন দলের সঙ্গে জোট গঠনের আলোচনা চলছে। শেষ পর্যন্ত সেটি কোন পর্যায়ে গিয়ে দাঁড়ায়, তা সময়ই বলে দেবে।”

সব মিলিয়ে বলা যায়, তারেক রহমানের সরাসরি তত্ত্বাবধানে পরিচালিত এই মনোনয়ন প্রক্রিয়া বিএনপির ভেতরে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করছে, একই সঙ্গে তরুণ ও যোগ্য নেতৃত্বকে সামনে আনার পথে একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচন করছে। এটি দলের নির্বাচনী প্রস্তুতিকে আরও সুসংহত করেছে এবং নেতাকর্মীদের মধ্যে নতুন উদ্দীপনা সঞ্চার করেছে।