সকালের আলো তখন পুরোপুরি ছড়িয়ে পড়েছে। কুয়াশা সরে গিয়ে পিলখানার মাঠ এখন স্পষ্ট, উন্মুক্ত। কিন্তু সেই আলোয় শান্তি নেই—আছে উত্তেজনা, আছে অদৃশ্য এক অস্থিরতা। হাতিদের শুঁড় নড়ছে, কান দুলছে, পা বদলাচ্ছে। তারা বুঝতে পারছে—আজ যাত্রা আছে।
গজরাজ স্থির দাঁড়িয়ে আছে, কিন্তু তার চোখে শান্তি নেই। বহুদিনের অভ্যাসে সে বুঝে নেয়, কখন শুধু শোভাযাত্রা আর কখন বিপদ। আজ বাতাসে ভিন্ন গন্ধ—ভেজা বন, কাঁচা কাঠ, আর অজানা আশঙ্কার গন্ধ।
করিম মাহুত গজরাজের গলায় দড়ি ঠিক করে বেঁধে দিচ্ছিল। তার হাতের নড়াচড়ায় কোনো তাড়াহুড়া নেই, কিন্তু মুখের রেখাগুলো কঠিন। রহমত পাশে দাঁড়িয়ে চুপচাপ তাকিয়ে আছে। সে জানে, আজ বাবার সঙ্গে সে যাবে না। খেদা অভিযানে শিশুদের জায়গা নেই।
“বাবা,” হঠাৎ করে রহমত বলল,
“ফিরে আসবে তো?”
করিম এক মুহূর্ত থামল। ছেলের দিকে তাকাল। চোখে মমতা, কিন্তু মুখে কোনো আশ্বাস নেই। শুধু বলল,
“হাতি ফিরলে আমিও ফিরব।”
এই কথার মানে রহমত তখন পুরোপুরি বুঝল না। কিন্তু বুকের ভেতর কেমন একটা ভার জমে উঠল।
শিঙ বাজল আবার। এবার দীর্ঘ, ভারী আওয়াজ। যাত্রার সংকেত।
হাতির সারি ধীরে ধীরে পিলখানার ফটক পেরিয়ে বাইরে বেরোতে লাগল। সামনে ব্রিটিশ সাহেবদের ঘোড়া, মাঝখানে হাতির দল, পেছনে সেপাইরা। ধুলা উড়ছে, রোদে ঝিলমিল করছে হাতির কপালের চামড়া।
ঢাকার গ্রামীণ পথ তখনো কাঁচা। দুই পাশে ধানক্ষেত, পাটখেত, মাঝে মাঝে ছোট ছোট গ্রাম। মানুষ কাজ থামিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ছে। কেউ ভয়, কেউ বিস্ময়, কেউ নিছক কৌতূহল নিয়ে তাকিয়ে আছে। শিশুদের চোখ বড় বড়। তারা এমন দৃশ্য আগে কখনো দেখেনি।
গজরাজ ধীরে চলছিল। প্রতিটি পা ফেলছে মেপে মেপে। করিম তার কানের পাশে বসে ফিসফিস করে কথা বলছে। এই ভাষা কারও কানে যায় না, শুধু হাতি আর মাহুতের মধ্যে বিনিময় হয়।
দিন গড়িয়ে বন ঘন হতে লাগল। শহরের সবুজ পেরিয়ে এখন তারা গভীর জঙ্গলের দিকে। এখানে বাতাস ভারী, আলো কম। পাখির ডাক অচেনা। মাটিতে পচা পাতার গন্ধ।
খেদা অভিযানের জায়গায় পৌঁছাতেই অস্থিরতা বাড়ল। বন্য হাতির পাল কাছেই আছে—এ খবর সবার জানা। ব্রিটিশ সাহেবদের চোখে উত্তেজনা, যেন শিকার শুরু হতে যাচ্ছে।
হঠাৎ দূর থেকে এক তীব্র শিঙের শব্দ ভেসে এলো।
বন্য হাতি।
পরপর কয়েকটি গাছ নড়ে উঠল। পাতা ঝরল। মাটি কেঁপে উঠল। বন্য হাতির পাল দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করছে। তখনই শুরু হলো খেদা।
গজরাজকে সামনে এগোতে নির্দেশ দেওয়া হলো। করিমের বুকের ভেতর কেঁপে উঠল। সে জানে, এই কাজ কতটা বিপজ্জনক। বন্য হাতির ভয়ানক শক্তি, উন্মত্ততা—সবই জানা।
গজরাজ শুঁড় তুলে গর্জন করল। সেই আওয়াজে জঙ্গল কেঁপে উঠল। বন্য হাতির পাল দিশেহারা হয়ে পড়ল। ধুলো, চিৎকার, শিঙের শব্দে চারপাশ এক বিভীষিকাময় দৃশ্য।
এক মুহূর্তে সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেল।
একটি বিশাল বন্য হাতি হঠাৎ গজরাজের দিকে তেড়ে এলো। তার চোখ লাল, শুঁড় উঁচু। করিম মুহূর্তের মধ্যে বুঝে গেল—এবার প্রাণের লড়াই।
“গজরাজ!”
সে চিৎকার করল।
গজরাজ পিছিয়ে গেল না। শুঁড় দিয়ে আঘাত ঠেকাল, তারপর পুরো শক্তি দিয়ে সামনে ধাক্কা দিল। দুই হাতির সংঘর্ষে মাটি কেঁপে উঠল। করিম কোনোমতে ভারসাম্য ধরে রাখল।
কিন্তু ঠিক তখনই দুর্ঘটনাটা ঘটল।
একটি ডাল ভেঙে পড়ল। করিমের কাঁধে আঘাত লাগল। সে ভারসাম্য হারিয়ে গজরাজের পিঠ থেকে পড়ে গেল।
সবকিছু যেন থমকে গেল এক মুহূর্তের জন্য।
গজরাজ পাগলের মতো গর্জন করল। শুঁড় তুলে করিমকে আড়াল করল নিজের শরীর দিয়ে। বন্য হাতিটি আর কাছে আসতে পারল না।
শেষমেশ সেপাইদের চিৎকার, গুলির শব্দে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এলো। বন্য হাতির পাল সরে গেল গভীর বনে।
করিম আহত। রক্ত ঝরছে। কিন্তু সে বেঁচে আছে।
গজরাজ মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। শুঁড় দিয়ে করিমের শরীর ছুঁয়ে দেখছে—যেন নিশ্চিত হতে চাইছে, সে এখনো আছে।
সন্ধ্যার দিকে দল ফিরে এলো পিলখানার পথে। যাত্রা এবার নীরব। কোনো শিঙ বাজছে না। শুধু ক্লান্ত হাতির পদচারণা।
রহমত দূরে দাঁড়িয়ে সব দেখল। বাবাকে আহত অবস্থায় দেখে তার বুক ফেটে যেতে চাইল। সে দৌড়ে গেল।
করিম ছেলের মাথায় হাত রাখল। হাসার চেষ্টা করল।
“দেখলি?” বলল ধীরে,
“হাতি কথা রাখে।”
সেই রাতে রহমত ঘুমোতে পারল না। তার চোখের সামনে ভেসে উঠছিল জঙ্গলের অন্ধকার, গজরাজের গর্জন, বাবার রক্তাক্ত মুখ।
সে বুঝতে শুরু করল—পিলখানা শুধু রাজকীয়তা নয়। এর ভেতরে আছে বিপদ, ত্যাগ আর নীরব বীরত্ব।
আর গজরাজ—সে শুধু একটি হাতি নয়। সে এক জীবন্ত ইতিহাস।
(চলবে…)