ঢাকা, মঙ্গলবার, ৩০ ডিসেম্বর ২০২৬,
সময়: ০৫:৩০:৪৮ AM

”এক শান্ত জনপদ” পর্ব–৫

মান্নান মারুফ
29-12-2025 02:02:00 PM
”এক শান্ত জনপদ” পর্ব–৫

সময় আর কারও জন্য থামে না। করিম মাহুত চলে যাওয়ার পর দিনগুলো যেন আরও দ্রুত এগোতে লাগল। পিলখানার মাঠে আগের মতো ভোরের শিঙ শোনা যায় না। হাতির পদচারণায় আর মাটি কাঁপে না। শুধু মাঝে মাঝে দূরের শহর থেকে ভেসে আসে নতুন এক শব্দ—লোহার চাকা ঘোরার শব্দ, মানুষের ভিড়ের গুঞ্জন, আর পরিবর্তনের অদৃশ্য ডাক।

রহমত তখন যুবক। বয়সে তরুণ, কিন্তু চোখে বয়সের ছাপ। বাবার মৃত্যুর পর সে পিলখানায় থেকে গেছে। সাহেবদের দেওয়া শিক্ষানবিশের কাজ সে নেয়নি। কারণ সেখানে হাতি নেই, আছে হিসাব, কাগজ আর আদেশ। সে নিজের জন্য শহরের ভেতরে কাজ খুঁজেছে—কখনো গুদামে, কখনো ঘোড়ার গাড়ির সহকারী হিসেবে।

ঢাকা বদলে যাচ্ছে।

যেখানে একসময় খোলা মাঠ ছিল, সেখানে এখন রাস্তা কাটা হচ্ছে। ইটের দালান উঠছে। পুরোনো গাছ কাটা পড়ছে। মানুষ বলছে—উন্নয়ন। কিন্তু রহমতের কাছে এই শব্দটার মানে একটাই—শূন্যতা।

একদিন কাজ শেষে সে পিলখানার পাশে দাঁড়াল। ভেতরে ঢোকার অনুমতি নেই। উঁচু দেয়াল, লোহার ফটক। সে চোখ বন্ধ করে কল্পনা করল—এই জায়গায় একসময় গজরাজ দাঁড়াত, বাবা তার কানের পাশে কথা বলত।

চোখ খুলতেই কানে এলো গাড়ির হর্ন।

এই শব্দ তার কাছে অচেনা, কর্কশ।

শহরের পথে পথে এখন মানুষ ব্যস্ত। কেউ আর হাতির দিকে তাকায় না, কারণ হাতি নেই। রাস্তায় চলছে ঘোড়ার গাড়ি, কিছু জায়গায় মোটরগাড়ি। মানুষ বলছে, এতে সময় বাঁচে।

রহমত ভাবে—কিন্তু স্মৃতি?

তার জীবনে পিলখানা এখন শুধুই স্মৃতি। রাতে ঘুমোতে গেলে সে এখনো শোনে গজরাজের শিঙ, বাবার গলা। কিন্তু ভোরে উঠে দেখে—চারপাশ বদলে গেছে।

কয়েক বছর পর ব্রিটিশ শাসনের রং ফিকে হতে থাকে। নতুন কথা শোনা যায়—স্বদেশ, অধিকার, আন্দোলন। রহমত এসব বোঝে না পুরোপুরি, কিন্তু বুঝতে পারে—ক্ষমতার রূপ বদলালেও তার ছায়া থাকে।

একদিন সে শহরের এক চায়ের দোকানে বসে শুনল,
“হাতি রেখে কী হবে? গাড়িই ভালো।”

কথাটা শুনে সে চুপ করে রইল। তর্ক করল না। কারণ সে জানে—এই শহর আর তার কথা শুনবে না।

পিলখানার ভেতরে তখন নতুন দালান উঠেছে। হাতির শেড ভেঙে ফেলা হয়েছে। সেখানে অফিস, গুদাম। মানুষ বদলে গেছে, জায়গা বদলে গেছে, শুধু মাটি একই আছে—নীরবে সব সহ্য করছে।

রহমত একদিন সাহস করে ভেতরে ঢুকতে চেয়েছিল। গার্ড তাকে থামিয়ে দিয়েছিল।
“এটা আর আগের জায়গা না,” বলেছিল সে।

এই কথাটা রহমতের বুকের ভেতর গভীরভাবে গেঁথে যায়।

সে বুঝে নেয়—পিলখানা এখন শুধু একটি জায়গা নয়, একটি হারিয়ে যাওয়া সময়।

বছর গড়িয়ে যায়। রহমত বিয়ে করে। সংসার হয়। শহরের এক কোণে ছোট ঘর। সন্তান হয়—একটি ছেলে। ছেলের নাম রাখে সে ‘গজু’। কেউ জানে না কেন।

রহমত কখনো কখনো ছেলেকে নিয়ে পিলখানার পাশ দিয়ে হাঁটে। ছেলেটা জিজ্ঞেস করে,
“আব্বা, এখানে আগে কী ছিল?”

রহমত চুপ করে থাকে। কীভাবে বোঝাবে—এখানে একসময় হাতির রাজ্য ছিল?

একদিন সে ছেলেকে বলল,
“এখানে হাতি থাকত।”

ছেলে হাসল।
“ঢাকায় হাতি? গল্প বানাও না।”

রহমত হাসল না। তার চোখে পানি এলো। সে বুঝল—গল্প আর ইতিহাসের মাঝখানে কত দ্রুত দেয়াল উঠে যায়।

শহর তখন আরও বড়। মানুষের সংখ্যা বেড়েছে। শব্দ বেড়েছে। কিন্তু কেউ খেয়াল করে না—এই শহরের বুকের ভেতর কত স্মৃতি চাপা পড়ে আছে।

এক সন্ধ্যায় রহমত পুরোনো একটি ছবি বের করল। সাদাকালো। সারিবদ্ধ হাতি, পিঠে মাহুত। ছবির এক কোণে বাবার মতো একজন মানুষ। আর সামনে—গজরাজ।

ছেলেটা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল।
“সত্যিই ছিল?” সে ফিসফিস করে বলল।

রহমত মাথা নেড়ে বলল,
“ছিল।”

সেই রাতে শহরের শব্দের মাঝেও রহমত এক অদ্ভুত শান্তি পেল। কারণ কেউ একজন অন্তত জানল—এই শহরের আগে আরেকটি শহর ছিল।

পিলখানা এখন আর হাতির নয়। কিন্তু স্মৃতির ভেতরে এখনো গজরাজ হাঁটে। এখনো বাবার কণ্ঠ ভেসে আসে।

শহর বদলে গেছে। মানুষ বদলে গেছে।
কিন্তু বদলায়নি—হারিয়ে যাওয়ার বেদনা।

(চলবে…)