বর্ষার শুরু তখন। আকাশ দিনের পর দিন ভারী হয়ে থাকে, বৃষ্টি নামলেও ঠিক স্বস্তি আসে না। পিলখানার মাঠে কাদা জমেছে, ঘাসের রং গাঢ় সবুজ। হাতিদের পায়ের ছাপে ছাপে জল থমকে থাকে। বাতাসে ভাসে ভেজা মাটির গন্ধ—সঙ্গে এক অদৃশ্য চাপ, যা শুধু প্রকৃতির নয়, সময়েরও।
করিম মাহুত এখনো পুরোপুরি সেরে ওঠেনি। কাঁধের ব্যথা মাঝেমধ্যে তীব্র হয়ে ওঠে। তবু সে প্রতিদিন গজরাজের কাছে আসে। শুঁড়ের ছোঁয়ায়, চোখের চাহনিতে গজরাজ যেন বুঝে নেয় তার মাহুতের যন্ত্রণা। দুই জীবের মাঝে এই নীরব বোঝাপড়া পিলখানার বহু মানুষের চোখে পড়ে, কিন্তু কেউ কিছু বলে না।
রহমত এখন আর আগের মতো ছোট নেই। বয়স বাড়েনি খুব, কিন্তু চোখে কিছু একটা বদলে গেছে। খেদা অভিযানের সেই দিনটি তার ভেতর থেকে শিশুসুলভ নির্ভারতা কেড়ে নিয়েছে। সে এখন লক্ষ্য করে—পিলখানার বাতাস বদলাচ্ছে।
এক সকালে সাহেবদের বড় বৈঠক বসেছে। পিলখানার ভেতরের অফিসঘরটিতে দেশি মাহুতদের ঢোকার অনুমতি নেই। তবু বাইরে দাঁড়িয়ে সবাই টের পাচ্ছে উত্তেজনা। দরজা বন্ধ, ভেতরে গম্ভীর কণ্ঠ, ইংরেজি ভাষার দ্রুত উচ্চারণ।
বৈঠক শেষে খবরটা ছড়িয়ে পড়ল—হাতির সংখ্যা কমানো হবে।
“খরচ বেশি,” একজন সেপাই বলল।
“এখন রেল হচ্ছে, গাড়ি আসছে,” আরেকজন যোগ করল।
এই কথাগুলো যেন পিলখানার বুকের ভেতর ছুরি বসিয়ে দিল। হাতি—যারা এতদিন ছিল শক্তি, গর্ব আর রাজকীয়তার প্রতীক—এখন তারা বোঝা।
করিম চুপচাপ শুনল। কিছু বলল না। তার অভিজ্ঞতায় সে জানে, ক্ষমতার ভাষায় যুক্তি মানে সিদ্ধান্ত, আর সিদ্ধান্ত মানে অবধারিত পরিবর্তন।
দিনের পর দিন হাতিদের তালিকা তৈরি হতে লাগল। কারা থাকবে, কারা যাবে। কিছু হাতি নিলামে তোলা হবে, কিছু পাঠানো হবে দূর প্রদেশে। কিছু—কেউ জানে না তাদের ভবিষ্যৎ।
গজরাজের নাম প্রথম তালিকায় নেই। সে শক্তিশালী, অভিজ্ঞ। সাহেবদের কাজে এখনো প্রয়োজন।
এই খবর শুনে রহমত একটু স্বস্তি পেল। কিন্তু করিম জানে—এ স্বস্তি ক্ষণস্থায়ী।
পিলখানার ভেতর এক অদ্ভুত বিভাজন তৈরি হতে লাগল। কিছু মাহুত সাহেবদের আনুগত্যে ব্যস্ত, তারা নতুন ব্যবস্থায় নিজেদের জায়গা পাকা করতে চায়। আবার কিছু মানুষ নীরবে ক্ষুব্ধ। তারা জানে, হাতির সঙ্গে সঙ্গে তাদের জীবনও মূল্যহীন হয়ে যাচ্ছে।
একদিন বিকেলে রহমত দেখল—একটি হাতিকে দড়ি দিয়ে বেঁধে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। হাতিটির চোখে ভয়, শুঁড় বারবার মাটিতে আঘাত করছে। তার মাহুত কাঁদছে, কিন্তু কিছু করতে পারছে না।
“ওকে কোথায় নিচ্ছে?” রহমত জিজ্ঞেস করল।
“বিক্রি,” কেউ একজন বলল সংক্ষেপে।
সেই শব্দটি—বিক্রি—রহমতের মাথার ভেতর ঘুরতে লাগল। হাতিও যে পণ্যে পরিণত হতে পারে, এ ধারণা তার বুকের ভেতর অদ্ভুত এক শূন্যতা তৈরি করল।
গজরাজ তখন দূরে দাঁড়িয়ে সব দেখছিল। তার কান সজাগ, চোখে অস্থিরতা। সে বুঝতে পারছে—তার চারপাশের জগৎ ভাঙছে।
এক সন্ধ্যায় করিম গজরাজের পাশে বসে অনেকক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর ধীরে বলল,
“সময় বদলাচ্ছে, বুঝছিস?”
গজরাজ শুঁড় বাড়িয়ে করিমের কাঁধ ছুঁয়ে দিল। কোনো ভাষা নেই, তবু কথাটা যেন পৌঁছে গেল।
সেই রাতে পিলখানায় অদ্ভুত এক নীরবতা নেমে এলো। দূরে শহরের দিকে নতুন শব্দ ভেসে আসছে—লোহার চাকা, দূরের ট্রেনের হুইসেল। এই শব্দ আগে এখানে ছিল না।
রহমত শুয়ে শুয়ে ভাবল—এই শব্দ কি একদিন হাতির শিঙকে ঢেকে দেবে?
কয়েক মাস পর করিমকে ডেকে পাঠানো হলো সাহেবদের সামনে। সিদ্ধান্ত জানানো হলো—তার বয়স, চোট আর পরিস্থিতি বিবেচনায় তাকে ধীরে ধীরে দায়িত্ব কমাতে হবে।
করিম মাথা নিচু করে শুনল। কোনো প্রতিবাদ নেই। শুধু বলল,
“গজরাজের খেয়াল রাখবেন।”
সাহেবদের একজন হাসল। সে হাসিতে মমতা নেই, আছে মালিকানার নিশ্চয়তা।
সেদিন করিম বুঝে গেল—পিলখানা আর আগের মতো নেই। এখানে এখন হাতির চেয়েও বড় হয়ে উঠছে ক্ষমতা।
রহমত বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে সব বুঝল। তার ভেতরে জন্ম নিতে লাগল এক প্রশ্ন—যদি হাতিরা চলে যায়, তাহলে পিলখানা কী থাকবে?
বর্ষার শেষে আকাশ পরিষ্কার হলো। কিন্তু পিলখানার আকাশে জমে থাকা ছায়া কাটল না। ক্ষমতার ছায়া ধীরে ধীরে দীর্ঘ হতে লাগল, ঢেকে ফেলল হাতির পদচিহ্ন, মাহুতদের স্বপ্ন।
আর সেই ছায়ার ভেতর দাঁড়িয়ে গজরাজ—এক জীবন্ত স্মৃতি, যে এখনো জানে না, তার যাত্রার সবচেয়ে কঠিন অংশটি সামনে অপেক্ষা করছে।
(চলবে…)