ঢাকা, মঙ্গলবার, ৩০ ডিসেম্বর ২০২৬,
সময়: ০৫:৩৪:৫৭ AM

”এক শান্ত জনপদ” পর্ব–৬

মান্নান মারুফ
29-12-2025 02:03:19 PM
”এক শান্ত জনপদ” পর্ব–৬

বয়স মানুষকে ধীরে হাঁটতে শেখায়। শরীর আর আগের মতো সাড়া দেয় না, কিন্তু মন থামে না। রহমত এখন বৃদ্ধ। মাথার চুল পেকে সাদা, চোখে চশমা। তবু চোখের গভীরে এখনো লুকিয়ে আছে এক কিশোর—যে ভোরের কুয়াশার ভেতর দাঁড়িয়ে হাতির শিঙ শুনত।

ঢাকা এখন এক অচেনা শহর। চারপাশে উঁচু দালান, কংক্রিটের দেয়াল, গাড়ির সারি। আকাশ ছোট হয়ে গেছে। শব্দের ভিড়ে নীরবতা আর জায়গা পায় না। তবু রহমত প্রতিদিন ভোরে উঠে জানালার পাশে দাঁড়ায়। কোনো কোনো সকালে তার মনে হয়—এই বুঝি শিঙ বাজল।

কিন্তু না। ওটা শুধু বাসের হর্ন।

তার ছেলে গজু বড় হয়েছে। এখন নিজের সংসার। নাতি–নাতনিরা আসে, যায়। তারা শহরের গল্প জানে, ইতিহাস নয়। রহমত তাদের দিকে তাকিয়ে ভাবে—সে কি কিছু রেখে যেতে পারবে?

একদিন সে পুরোনো কাঠের সিন্দুক খুলল। ভেতরে কিছু কাগজ, একটি ফাটা পাগড়ি, আর সেই সাদাকালো ছবি। হাতির সারি, পিঠে মাহুত। ছবির এক কোণে করিম মাহুত। আর সামনে—গজরাজ।

ছবিটা হাতে নিয়ে তার হাত কাঁপে। স্মৃতি হঠাৎ ভারী হয়ে ওঠে। মনে পড়ে—গজরাজের চোখ, বাবার কণ্ঠ, পিলখানার খোলা মাঠ।

সে ছবিটা নাতির সামনে ধরল।
“এইটা কী দাদু?”
“এইটা আমার শহর,” রহমত বলল ধীরে।

নাতি অবাক হয়ে তাকাল। তার চোখে হাতি মানে চিড়িয়াখানা। শহরে হাতির গল্প তার কাছে রূপকথা।

রহমত বুঝল—স্মৃতি যদি বলা না হয়, তা হারিয়ে যায়।

সেই দিন থেকে সে লিখতে শুরু করল। কাগজে, ধীরে ধীরে। হাত কাঁপে, তবু লেখে। পিলখানা, গজরাজ, করিম মাহুত—সব।

লেখার ফাঁকে ফাঁকে তার শরীর ক্লান্ত হয়। কখনো মনে হয়—সে নিজেই এক বোঝা হয়ে গেছে। পরিবারের জন্য, শহরের জন্য।

এক বিকেলে সে পিলখানার কাছাকাছি গেল। ভেতরে ঢোকার অনুমতি নেই। দূর থেকে তাকিয়ে রইল। উঁচু দেয়াল, কড়া পাহারা। কোথাও হাতির কোনো চিহ্ন নেই।

তবু সে চোখ বন্ধ করতেই মাঠ দেখতে পেল। কুয়াশা, ঘাস, হাতির সারি।

“সব মুছে গেছে,” পাশে দাঁড়ানো এক যুবক বলল।
রহমত মাথা নেড়ে বলল,
“না। মাটির নিচে আছে।”

যুবক বুঝল না। চলে গেল।

সন্ধ্যায় রহমত বাড়ি ফিরে এল। শরীর ভেঙে পড়েছে। ডাক্তার বলেছে—বিশ্রাম দরকার। কিন্তু তার মনে বিশ্রাম নেই।

রাতে ঘুমের ভেতর সে আবার গজরাজকে দেখল। বিশাল শরীর, শান্ত চোখ। গজরাজ তার দিকে তাকিয়ে আছে।

“সব কি ভুলে গেছ?”
হাতির চোখ যেন প্রশ্ন করে।

রহমত ঘুম ভেঙে উঠল। চোখ ভেজা।

সে জানে—এ স্মৃতি বহন করা সহজ নয়। কিন্তু না বহন করলে ইতিহাস হারিয়ে যাবে।

একদিন সে নাতিকে নিয়ে বসে গল্প বলল। শহরের গল্প নয়, পিলখানার গল্প। হাতির গল্প।

নাতি মন দিয়ে শুনল। প্রশ্ন করল।
“তারা কোথায় গেল?”
রহমত বলল,
“সময়ের ভেতরে।”

এই কথাটার মানে সে নিজেই পুরোপুরি জানে না। তবু সত্যি।

রহমত বুঝতে শুরু করল—স্মৃতি শুধু ব্যক্তিগত নয়, দায়। এই দায় সে কাউকে দিতে পারবে না, কিন্তু কাউকে না কাউকে দেখাতে হবে।

তার লেখা কিছু পাতা জমেছে। সে ভাবছে—হয়তো একদিন কেউ পড়বে। হয়তো পড়বে না। তবু লেখা দরকার।

ঢাকা রাতে আরও জেগে ওঠে। আলোয়, শব্দে। রহমত জানালার পাশে বসে শোনে। তার কানে এই শব্দের নিচে এখনো শোনা যায়—এক দীর্ঘ, ভারী শিঙ।

স্মৃতি ভারী। কিন্তু সেই ভারই তাকে বাঁচিয়ে রেখেছে।

সে জানে—শেষ যাত্রা আর বেশি দূরে নয়। তার পরে কী থাকবে, সে জানে না।

কিন্তু সে চায়—যখন সে থাকবে না, তখনও কেউ একজন যেন বলতে পারে,
“একদিন এখানে হাতিরা হেঁটেছিল।”

(চলবে…)