(ইতিহাসের রূপান্তর)
সময় থেমে থাকে না, কিন্তু কোনো কোনো জায়গা সময়ের সব ভার বয়ে বেড়ায়। পিলখানা তেমনই এক জায়গা। যে মাটি একদিন হাতির পদচারণায় কেঁপে উঠত, সেই মাটিই এখন বয়ে নেয় ভিন্ন এক ইতিহাস—কঠিন, রক্তাক্ত, এবং নিঃশব্দে ভারী।
রহমত তখন আর খুব বেশি হাঁটতে পারে না। বয়স, অসুখ, স্মৃতির ভার—সব মিলিয়ে শরীর ক্লান্ত। তবু খবরের কাগজ পড়া সে ছাড়েনি। কারণ সে জানে, এই শহরের প্রতিটি খবরের সঙ্গে কোথাও না কোথাও তার অতীত জড়িয়ে আছে।
সেদিন ভোরে শহরের বাতাস অস্বাভাবিক ভারী ছিল। জানালার বাইরে কোনো পাখির ডাক নেই। দূরে দূরে সাইরেনের শব্দ। রহমত খবরের কাগজ হাতে নিল। প্রথম পাতার বড় শিরোনাম তার চোখে ঝাঁপিয়ে পড়ল।
পিলখানা।
হাত কেঁপে উঠল। চোখের চশমা খুলে আবার পড়ল। খবরের ভাষা কঠিন, সংক্ষিপ্ত—সংঘর্ষ, প্রাণহানি, রক্তপাত। সে শব্দগুলো পুরোপুরি বোঝার আগেই বুকের ভেতর কেমন যেন ফাঁকা হয়ে গেল।
পিলখানা—যে নাম শুনলেই তার চোখে ভেসে ওঠে কুয়াশা, হাতি, বাবার মুখ—আজ সেই নামের পাশে লেখা রক্তের গল্প।
সারা দিন টেলিভিশনে সেই খবরই চলল। মানুষ বলছে, বিশ্লেষণ করছে, দোষ দিচ্ছে। শহর স্তব্ধ। কিন্তু রহমতের কাছে এই সবকিছুর ভেতরে আরেকটি স্তর আছে—যা কেউ বলছে না।
সে চোখ বন্ধ করল।
তার চোখের সামনে ভেসে উঠল পিলখানার মাঠ। খোলা আকাশ। হাতির সারি। গজরাজের ভারী পা। তারপর হঠাৎ দৃশ্য বদলে গেল—উঁচু দেয়াল, অস্ত্র, মানুষের চিৎকার।
এক জায়গা, দুই সময়।
রহমত বুঝল—ইতিহাস কখনো মুছে যায় না, শুধু রূপ বদলায়।
পিলখানা এখন আর হাতির রাজ্য নয়। এটি ক্ষমতার এক কঠিন কেন্দ্র। আগে ছিল ঔপনিবেশিক শাসনের শক্তি, পরে রাষ্ট্রের নিরাপত্তা। রূপ বদলেছে, কিন্তু শক্তির ছায়া রয়ে গেছে।
সে ভাবল—হাতিরা ছিল নীরব শক্তি। তারা কথা বলত না, কিন্তু বোঝাত। আজকের শক্তি কথা বলে, আদেশ দেয়, আর রক্ত ঝরায়।
এই তুলনাটা তাকে কাঁপিয়ে দিল।
বিকেলে নাতি এসে বসেছিল তার পাশে। টেলিভিশনের দিকে তাকিয়ে সে জিজ্ঞেস করল,
“দাদু, এই জায়গাটা কি তোমার সেই পিলখানা?”
রহমত কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল। তারপর ধীরে বলল,
“হ্যাঁ।”
নাতি আর কিছু বলল না। তার চোখে ভয়, বিস্ময়। রহমত বুঝল—এই জায়গার গল্প নতুন প্রজন্মের কাছে শুরু হচ্ছে ভিন্নভাবে।
সেই রাতে রহমত ঘুমোতে পারল না। জানালার পাশে বসে শহরের শব্দ শুনল। আজ সেই শব্দে কোনো ছন্দ নেই। কেবল চাপা উত্তেজনা।
তার মনে হলো—পিলখানার মাটি আবার কাঁপছে। কিন্তু এবার হাতির পায়ে নয়।
সে সিন্দুক থেকে সেই পুরোনো ছবি বের করল। সাদাকালো। হাতি, মাহুত। ছবির দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বলল,
“তোমরা থাকলে কি এটা হতো?”
কোনো উত্তর এল না। শুধু স্মৃতি।
পরদিন সে আবার লিখতে বসলো। হাত কাঁপছে। তবু লিখল। কারণ এখন সে বুঝেছে—এই গল্প বলা আরও জরুরি।
সে লিখল—এক জায়গার ইতিহাস শুধু ইট-পাথরের নয়। সেখানে জমে থাকে মানুষের আশা, ভয়, ক্ষমতা আর রক্ত।
পিলখানা তার কাছে আর কেবল হারানো শৈশব নয়। এটি এক আয়না, যেখানে শহর নিজের মুখ দেখে।
কয়েক দিন পর পরিস্থিতি ধীরে ধীরে শান্ত হলো। সংবাদ কমে এলো। মানুষ অন্য খবরে মন দিল। কিন্তু রহমতের ভেতর কিছু শান্ত হলো না।
সে জানে—এই রক্তাক্ত অধ্যায়ও একদিন ইতিহাস হয়ে যাবে। কেউ কেউ মনে রাখবে, কেউ ভুলে যাবে।
ঠিক যেমন হাতিরা হারিয়ে গেছে।
এক বিকেলে সে শেষবারের মতো পিলখানার দিকে তাকাল দূর থেকে। দেয়ালের ওপারে কী হচ্ছে সে জানে না। কিন্তু সে জানে—এই মাটির নিচে এখনো হাতির পদচিহ্ন আছে। তাদের নীরবতা আছে।
ইতিহাস বদলায়, কিন্তু জায়গা কথা বলে—যদি কেউ শোনে।
রহমত দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তার চোখে পানি এলো না। শুধু এক ধরনের ক্লান্ত উপলব্ধি।
পিলখানা রক্তাক্ত হয়েছে।
কিন্তু তার স্মৃতি এখনো বেঁচে আছে।
আর সেই স্মৃতিই হয়তো একদিন মানুষকে মনে করিয়ে দেবে—
শক্তি মানে শুধু ক্ষমতা নয়, দায়িত্বও।
(চলবে…)