ঢাকা, শুক্রবার, ৬ জুন ২০২৫,
সময়: ১১:০৮:২০ PM

নির্বাচন ডিসেম্বরে না জুনে এ বিতর্কের শেষ কোথায়

স্টাফ রিপোটার।। দৈনিক সমবাংলা
05-06-2025 05:14:43 PM
নির্বাচন ডিসেম্বরে না জুনে এ বিতর্কের শেষ কোথায়

 নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে তীব্র উত্তেজনা বিরাজ করছে। নির্বাচন ডিসেম্বরে না জুনে এ বিতর্কের শেষ কোথায় । অন্তর্র্বতী সরকার ২০২৬ সালের জুনের মধ্যে প্রয়োজনীয় সাংবিধানিক ও প্রশাসনিক সংস্কার শেষে নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজনের পক্ষে, যেখানে ‘জুলাই সনদ’ প্রকাশের মাধ্যমে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন নিশ্চিত করতে চায়।অন্যদিকে বিএনপি দৃঢ় অবস্থায়, ২০২৫ সালের ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচন দাবি করছে। কারণ তাদের মতে, সময় বাড়ালে গণতন্ত্রের জন্য বড় ধরনের হুমকি সৃষ্টি হবে এবং ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করার ষড়যন্ত্র চলছে। বিএনপির আশঙ্কা, এই দেরিতে পতিত ফ্যাসিবাদের পুনরুজ্জীবন ঘটতে পারে, যেখানে এনসিপি ও কিছু ইসলামপন্থী দলের সমর্থন রয়েছে। এ নিয়ে বিএনপি ছাড়াও বেশিরভাগ রাজনৈতিক দল একমত। এখন নির্বাচন কবে হবে, ডিসেম্বরে না কী জুনে তা নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে বিতর্ক ছড়িয়ে পড়েছে।
নির্বাচন কেন জুনে, কেন এর আগে নয় এবং কেনই বা ডিসেম্বরে, এর পরে নয়— এমন জটিলতার পেছনে কোন বাস্তবতা, আশঙ্কা বা কৌশল লুকিয়ে আছে, এ প্রশ্ন রাজনৈতিক অঙ্গনে । বিশ্লেষকরা বলছেন, সরকার আগামী জুনে নির্বাচনের কথা বলছে, কারণ তারা হয়ত মনে করে তখন দেশের পরিস্থিতি বেশি স্থির হবে। নির্বাচন প্রস্তুতি সম্পূর্ণ হবে। কিন্তু এর আগের সময়ে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও প্রশাসনিক তৎপরতার অভাব আশঙ্কা তৈরি করে। অন্যদিকে, ডিসেম্বরে নির্বাচনের পক্ষে আছে রাজনৈতিক দলের সমন্বয় ও জনমতের সুযোগ, তবে শীতকালে ভোটগ্রহণে দুরত্ব ও পরিবহন সমস্যা রয়েছে। এসব সময়সূচি নিয়ে রাজনৈতিক কৌশল, ক্ষমতার লড়াই ও আন্তর্জাতিক প্রভাবও জড়িয়ে রয়েছে, যা নির্বাচন টিকিয়ে রাখতে কঠিন পরিস্থিতি তৈরি করছে।বিএনপির নেতারা সতর্ক করে বলেছেন, ছাত্র-জনতার আন্দোলনের বিজয় যদি কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর জন্য সীমাবদ্ধ থাকে, তাহলে তাদের জায়গা হবে ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে। অন্যদিকে, সরকারের কিছু উপদেষ্টার বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে, তারা দলটির ভাবমূর্তি নষ্ট করার জন্য নানা অপপ্রচার চালাচ্ছেন। তাদের শীর্ষ নেতৃত্ব থেকে আসা এমন অভিযোগ আরও জোরালো হয়েছে তখন, যখন অন্তর্র্বতী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস মন্তব্য করেন, ‘একটি মাত্র দলই ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন চায়। ’ নেতারা মনে করছেন, জাপানে বসে ড. ইউনূসের এমন মন্তব্য মূলত বিএনপিকে ঘিরেই। ফলে রাজনীতির মাঠ সরগরম হয়ে উঠেছে।

বিএনপিসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলো মনে করেন, অন্তর্র্বতী সরকার প্রধানের এমন মন্তব্যে দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার ইঙ্গিত পাওয়া গেছে। এ পরিস্থিতিতে বিএনপির সন্দেহও আরও গাঢ় হয়েছে। দলটি মনে করে, সরকার নির্বাচনের সঠিক রোডম্যাপ না দিলে পুনরায় মাঠে নামতে হবে, আন্দোলন সংগঠিত করতে হবে। মাঠ পর্যায়ে বিষয়টি নিয়ে স্পষ্ট আভাস আছে, এমন তথ্য মিলেছে। একই সময়ে রাজনৈতিক মহলে এমন গুঞ্জনও ছড়িয়েছে, ‘ভারতীয় দিক থেকে চাপের মুখে বিএনপি ডিসেম্বরে ভোট চায়!’যদিও এমন গুঞ্জন ভিত্তিহীন বলে মনে করেন অনেকেই। গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি সম্প্রতি এক বক্তব্যে বলেছেন, নিজেদের প্রয়োজনেই বিচার, সংস্কার ও নির্বাচন দরকার। তিনি বলেন, ভারতীয় পৃষ্ঠপোষকতায় শেখ হাসিনা সরকার যে ফ্যাসিস্ট রোলার চালিয়েছিল, তার বিরুদ্ধে দেশে ঐক্য গড়ে উঠেছে। এখন জাতীয় সংসদ নির্বাচন ভারতের এজেন্ডা— এমন কথা বলে জনগণের ঐক্যে ফাটল ধরিয়ে ওই দেশটির পারপাস সার্ভ করা হচ্ছে। এ প্রচার ফ্যাসিস্টদের পুনর্বাসনে সাহায্য করবে।

জাতীয় নাগরিক পার্টিসহ (এনসিপি) অনেকেই ভাবছে, ভারতের সুরে বিএনপিও দ্রুত নির্বাচনের দাবি জানিয়ে একটি ফাঁদে পা দিচ্ছে। কিন্তু ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ভারতের স্বার্থে আঘাত লাগায়, দেশটি চাইছে এই দেশকে বিপথগামী করার। এর অংশ হিসেবে দ্রুত নির্বাচনের কথা বলছে ভারত। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরাও এমনটাই ধারণা করছেন।

এছাড়া, আওয়ামী লীগ আমলে বাংলাদেশের ওপর যেভাবে ভারত কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে, ইউনূস আমলে তা কষ্টকর হয়ে যাচ্ছে। আবার নিজেদের আওতা থেকে বাংলাদেশ চীনের বলয়ে চলে গেলে তা ভারতের জন্য অশনিসংকেত। তবে এতে বিএনপির দ্রুত নির্বাচনের দাবির সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ পাওয়া যায় না।বর্তমানে বিএনপির বিরুদ্ধে এমন একটি প্রচারণা চালানো হচ্ছে, যেটা আসলে ভারতের নিয়ন্ত্রিত কিছু এজেন্টের মাধ্যমে করা হচ্ছে। তারা খুবই কৌশলপূর্ণভাবে বিএনপির ওপর ‘ভারতীয় এজেন্ট’ হওয়ার আভাস ছড়াচ্ছে। রাজনীতি নিয়ে যারা কাজ করেন, তাদের অনেকেই মনে করেন, এই ধরনের কথা অনেক সময় ভুল বোঝাবুঝির কারণে ছড়ায়। অনেক বিএনপি সমর্থক সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবী হয়তো বুঝতে পারছেন না যে তারা এক ধরনের পরিকল্পিত ফাঁদে পড়ছেন।

রাজনীতির অভিজ্ঞ ব্যক্তিরা বলছেন, ভারতের এজেন্টরা আসলে ইউনুস সরকারকে দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় রাখতে চাইছে। এর ফলে দেশের গণতন্ত্র ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং ভারতের রাজনৈতিক প্রভাব বেড়ে যাবে। কারণ নির্বাচিত সরকারের ওপর প্রভাব বিস্তার করাটা তখন সহজ হয়ে যায়। তাদের যুক্তি হলো, পাশ্ববর্তী দেশ যেমন শ্রীলংকা, মালদ্বীপ ও নেপালে নিয়মিত নির্বাচন হওয়ায় ভারত সেখানে নিজের আধিপত্য টিকিয়ে রাখতে পারেনি। কিন্তু যদি আমাদের দেশে নির্বাচন নিয়ে বিব্রতকর পরিস্থিতি তৈরি হয় এবং সরকার দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকে, তাহলে ভারতের কূটনৈতিক প্রভাব অনেক বেশি শক্তিশালী হবে।

অন্তর্র্বতী সরকার বলছে, গত ১৫-১৬ বছর ধরে দেশে প্রশাসন পক্ষপাতদুষ্ট হয়ে গেছে, রাজনীতিতে অনেক বিশৃঙ্খলা দেখা গেছে, আর নির্বাচন কমিশনও যথেষ্ট যোগ্য নয়। এই সব সমস্যা ঠিক না করলে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হওয়া সম্ভব নয়।সরকারের মত, ভালো ও সবাই গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচনী ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য সময় প্রয়োজন। তারা বলছে, বিচার বিভাগ থেকে শুরু করে নির্বাচন কমিশন, স্থানীয় প্রশাসন, পুলিশ—সব জায়গায় নিরপেক্ষতা ফিরিয়ে আনার জন্য আগামী বছরের জুন পর্যন্ত সময় দরকার।

সরকারের কাছাকাছি থাকা কিছু বুদ্ধিজীবী ও নীতিনির্ধারক বলছেন, ‘জুলাই সনদ’ প্রকাশের মাধ্যমে দেশের ভবিষ্যতের রাজনীতি ও প্রশাসনের মূল পরিকল্পনা নির্ধারিত হবে। এই সনদের ভিত্তিতে একটি জাতীয় সংলাপ অনুষ্ঠিত হবে, এবং তারপর নির্বাচন আয়োজনের বিস্তারিত রোডম্যাপ ঘোষণা করা হবে। তাদের মতে, এই পুরো প্রক্রিয়াটি দেশের গণতন্ত্রকে নতুন করে গড়ে তোলার জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ ও ঐতিহাসিক সুযোগ। তাই এটা তাড়াহুড়ো করে শেষ করার বদলে সময় নিয়ে সঠিকভাবে সম্পন্ন করা উচিত।

অন্যদিকে, বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, যদি নির্বাচনের সময় বাড়ানো হয়, তা হবে জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ করা। দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ স্পষ্টভাবে জানিয়েছেন, ৩১ ডিসেম্বরের পরে আর কোনো সময় বাড়ানো হবে না। তার যুক্তি হলো, নির্বাচন পিছিয়ে গেলে দেশে আবার একটা পতিত ফ্যাসিবাদ জাগতে পারে। তিনি বাংলানিউজকে বলেছেন, ‘জরুরি প্রয়োজনীয় সংস্কারগুলো এক মাসের মধ্যে নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে করা সম্ভব। সংবিধান সংশোধন ছাড়া বাকি সব সংস্কার দ্রুত বাস্তবায়ন করা যায়। ’বিএনপি মনে করে, অনেক দিন ধরেই সাধারণ মানুষ ভোটের অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছে। তাই তারা নির্বাচন বিলম্ব করার পক্ষে নেই। তাদের মতে, নির্বাচন সংশ্লিষ্ট বাকি সংস্কার করার অধিকার নির্বাচিত সরকারেরই আছে। দলটি উদ্বিগ্ন, কেননা সময় বাড়ানো হলে কিছু ‘বুদ্ধিজীবী’ এবং দেশ-বিদেশের চক্রান্তকারীরা দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করে দিতে পারে। তারা চান অন্তর্র্বতী সরকারকে পাঁচ বছর বা তার বেশি সময় ক্ষমতায় রাখা হোক। এছাড়া বিএনপি এই আশঙ্কাও করছে যে, সময় বাড়ানোর কারণে জাতীয় সরকার গঠিত হতে পারে, যা তাদের একক ক্ষমতায় যাওয়ার সুযোগ কমিয়ে দিতে পারে।

সম্প্রতি বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানও জাতীয় নির্বাচন নিয়ে টালবাহানার অভিযোগ তুলে বলেছেন, ‘নির্বাচন প্রসঙ্গে অনিশ্চয়তা এবং সংস্কার নিয়ে সময়ক্ষেপণের আড়ালে ভিন্ন কোনো উদ্দেশ্য রয়েছে। ’

বিএনপির মতো বেশির ভাগ রাজনৈতিক দল দ্রুত নির্বাচন চাইলেও জামায়াত ও জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) সরকারের সময় বাড়ানোর পক্ষে। এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম মনে করেন, নির্বাচন রোডম্যাপ বা তারিখ আগে ঘোষণা করলে প্রয়োজনীয় সংস্কারের কাজ বাধাগ্রস্ত হতে পারে। তবে বিএনপির নেতারা এনসিপিকে সরকারের ‘আশীর্বাদপ্রাপ্ত কিংস পার্টি’ হিসেবে দেখে থাকেন। তারা বিশ্বাস করেন, নির্বাচন পেছানোর পেছনে সরকারের সঙ্গে এনসিপির কোনো গোপন সমঝোতা রয়েছে। বিএনপি তাদের দাবি করে, এনসিপির প্রতি প্রধান উপদেষ্টা ইউনূসের দুর্বল দৃষ্টিভঙ্গি আছে। জামায়াত ও এনসিপি প্রায় একই অবস্থান নিয়ে সরকারকে সমর্থন করছে, যেখানে বিএনপিকে বিরোধী হিসেবে প্রতিপক্ষ বানানোর ষড়যন্ত্র চলছে বলে বিএনপি অভিযোগ করছে।এ প্রসঙ্গে এনসিপির যুগ্ম সদস্য সচিব অ্যাডভোকেট হুমায়রা নূর বলেন, ‘শুরু থেকেই আমরা চাইছি জুলাই সনদ, পতিত ফ্যাসিবাদী সরকারের বিচার এবং মৌলিক সংস্কার। এই পরিস্থিতিতে নির্বাচন নিয়ে যেসব পরিকল্পনা চলছে, আমরা সেগুলো নিয়ে খুবই সন্দেহপ্রকাশ করছি। ’

তিনি বলেন, ‘যারা গত ১৫ বছর আন্দোলন করে পতিত ফ্যাসিবাদী সরকারের পতন ঘটাতে পারেননি, তারা জুলাই আন্দোলনে শহীদ ও আহতদের আত্মত্যাগকে মূল্য দিয়ে না সরাসরি নির্বাচন চাচ্ছেন। জুলাই আন্দোলনের মূল কারণ ছিল স্বৈরশাসনের পতন। স্বৈরশাসকের পতন হলেও, এখনো সংবিধানে স্বৈরশাসন তৈরি করার প্রক্রিয়া রয়েছে, যা বিভিন্ন রাজনৈতিক দল তাদের ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য ব্যবহার করছে। ’

হুমায়রা নূর সতর্ক করে বলেন, সংবিধান সংস্কার না করে নির্বাচনে গেলে বাংলাদেশকে সত্যিকার অর্থে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিণত করা সম্ভব হবে না। ’এই সরকারের আমলে বিভিন্ন পেশাজীবী গ্রুপ নানা দাবিতে প্রায়ই রাস্তায় এসে আন্দোলন করছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, নির্বাচিত সরকার ছাড়া এসব সমস্যার স্থায়ী সমাধান দেওয়া খুবই কঠিন। তারা আরও বলছেন, দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য একটি নির্বাচিত সরকার থাকা আবশ্যক। কারণ, জনগণ তাদের ভোটের মাধ্যমে নিজেদের প্রতিনিধি নির্বাচন করে এবং দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষার দায়িত্ব তাদের হাতে দেয়। সেই সঙ্গে জনগণ নির্বাচিত সরকারের কাছে জবাবদিহিতাও প্রত্যাশা করে। এই কারণে বিশ্লেষকরা বিশ্বাস করেন, গণতান্ত্রিক নিয়মে দেশ পরিচালনার জন্য নির্বাচিত সরকারের বিকল্প নেই।

বিএনপির দাবি যে মৌলিক সংস্কার এক মাসের মধ্যে করা সম্ভব, সেই দাবির পরিপ্রেক্ষিতে এনসিপি নেত্রী হুমায়রা নূর বলেন, ‘অন্তর্র্বতী সরকার বিভিন্ন কমিশন গঠন করেছে, যারা সংস্কারের কাজ করছে। সব রাজনৈতিক দল ঐকমত্যে আসার চেষ্টা করছে। আমরাও চাই এই প্রক্রিয়া দ্রুত শেষ হোক। তবে যদি সংস্কার সত্যিই এক মাসে সম্ভব, তাহলে কেন আমরা এখনও জুলাই সনদ পাইনি? কেন আবারও রাস্তায় আন্দোলন করতে হয়েছে? তাই আমাদের মতে, সংস্কার যদি এক মাসে করা যায়, তাহলে তার প্রধান শর্ত হবে জুলাই সনদ। সেই সনদ এবং সংস্কার হয়ে গেলে নির্বাচনে আমাদের কোনো আপত্তি থাকবে না। ’

এনসিপিকে অন্তর্র্বতী সরকারের আশীর্বাদপুষ্ট বা ‘কিংস পার্টি’ বলে বিএনপির করা মন্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় হুমায়রা বলেন, ‘অন্তর্র্বতী সরকার গঠনের আগে জুলাই আন্দোলনের ছাত্র নেতারা জনাব তারেক রহমানকে জাতীয় সরকারের প্রস্তাব দিয়েছিলেন, কিন্তু তিনি সেটিতে একমত হননি। এরপর বিএনপি ও অন্যান্য সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা করে অন্তর্র্বতীকালীন সরকারের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ’তিনি বলেন, ‘এই সরকারের উপদেষ্টামণ্ডলীতে কারা থাকবেন, তা সবার সম্মতিতে নির্ধারণ করা হয়েছে। সেই সঙ্গে উপদেষ্টামণ্ডলীতে তিনজন ছাত্র প্রতিনিধির বিষয়টিও সর্বসম্মতিতে ঠিক করা হয়েছে। জুলাই আন্দোলনের আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণ না হওয়া, জুলাই সনদ না ঘোষণার কারণে এবং রাজনীতির মূল মাঠে না আসার কারণে আমাদের কাজ করার সুযোগ সীমিত হয়ে আসছিল। এজন্য এনসিপি গঠন করতে হয়েছে। বিএনপি এনসিপিকে কিংস পার্টি বললেও, ৫ আগস্টের পর দেখা যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন প্রশাসনিক স্থানে বিএনপি ও জামায়াত সমর্থিত ব্যক্তিরা রয়েছেন। তারা একে একে মামলায় খালাস পাচ্ছেন এবং কোরবানির হাটের ইজারা নিচ্ছেন। উপদেষ্টামণ্ডলীর মধ্যেও বিএনপি ও জামায়াত সমর্থিত সদস্যদের থাকার প্রমাণ আমরা দিতে পারি। সুতরাং, এনসিপি সম্পর্কে ভিত্তিহীন অভিযোগ করা ঠিক হবে না। ’

সম্প্রতি দেশের ৩০টি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার বৈঠক চলাকালীন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ এবং এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম সরাসরি বাকযুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন। সালাহউদ্দিন প্রধান উপদেষ্টাকে জানান, বিএনপি ডিসেম্বরের পর সময় বাড়ানোর পক্ষে নয় এবং অন্যান্য সংস্কার এক মাসের মধ্যে করা সম্ভব।

এ সময় নাহিদ বলেন, ‘কিছু দল ভারতের সুর মিলিয়ে ডিসেম্বরেই নির্বাচন চায়। ’ এ কথা শুনে সালাহউদ্দিন উত্তপ্ত প্রতিক্রিয়া দেন এবং বলেন, ‘যদি ডিসেম্বরেই নির্বাচন চাওয়া মানে ভারতের সুরে কথা বলা হয়, তাহলে যারা নির্বাচন পেছাতে চায় তারা যুক্তরাষ্ট্র বা চীনের সুরে কথা বলছে। ’ প্রধান উপদেষ্টার সামনে দুই দলের নেতাদের এই প্রকাশ্যে বাকযুদ্ধ দেশের রাজনৈতিক পরিবেশে উত্তেজনা বাড়াচ্ছে।এই বৈঠকে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ভূমিকা নিয়ে বিশ্লেষকরা মনে করছেন, তিনি আপাতত বিএনপিকে জুলাই সনদ তৈরির কথা বলেই চুপ করিয়ে রাখতে চাইছেন। ওই সনদে জাতীয় ঐকমত্য গড়ার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত থাকবে এবং বিএনপির অবস্থান কড়া নজরে রাখা হবে।

তবে একাধিক সূত্র জানাচ্ছে, জুলাই সনদ নিয়ে গত বছর শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে যে আন্দোলন হয়েছিল, তার প্রভাব হিসেবে রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর বিশেষ করে বিএনপির প্রতি মানসিক চাপ তৈরি হয়েছে। কারণ ওই শিক্ষার্থীরা দ্রুত সনদ বাস্তবায়ন দেখতে চায়। ড. ইউনূসের বক্তব্য থেকে মনে হচ্ছে, তিনি ওই শিক্ষার্থীদের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করেছেন, যাদের ‘জুলাই বিপ্লব’ আন্দোলন দেশে ব্যাপক সমর্থন পেয়েছে।

দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই ড. মুহাম্মদ ইউনূস জানিয়েছিলেন, সংস্কার ও ঐকমত্যের ওপর ভিত্তি করে একটি সনদ তৈরি করা হবে। বর্তমানে তিনি সেই প্রক্রিয়ায় সক্রিয় রয়েছেন।জানা গেছে, বাংলাদেশের রূপরেখা, বর্তমান ও ভবিষ্যতের সংস্কার কর্মসূচি এবং সংস্কারের ধারাবাহিকতা নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোকে প্রতিশ্রুতি দিতে হবে, যাকে ‘জুলাই সনদ’ বলা হচ্ছে। একই সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টা সংলাপের মাধ্যমে বার্তা দিয়েছেন, দেশের সব রাজনৈতিক দল যতই মতপার্থক্য রাখুক না কেন, সবাইকে একসাথে বসে কথা বলার পরিবেশ এখনো রক্ষা করা হচ্ছে।

বিএনপির দ্রুত নির্বাচনের দাবি, এনসিপির জুলাই সনদ প্রণয়নের কথা এবং অন্তর্র্বতী সরকারের আগামী বছর জুন পর্যন্ত সময় চাওয়ার বিষয়গুলো নিয়ে দ্বন্দ্বের সমাধান দেশের গণতন্ত্র ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য খুবই জরুরি। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, দেশের ভালোর জন্য সকল রাজনৈতিক দলকে আলোচনায় বসে ঐকমত্য গড়ে তুলতে হবে। যাতে নির্বাচন দ্রুত হয়, কিন্তু সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য হয়। অন্যথায়, এই দীর্ঘসময় ধরে চলা দ্বন্দ্ব দেশের রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা বাড়াবে, যা দেশের সার্বভৌমত্ব এবং জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকারকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।রাজনৈতিক বিশ্লেষক দিলারা চৌধুরী এ প্রসঙ্গে  বলেন, ‘জাতি এখন সংকটের মধ্যে আছে। প্রতিটা রাজনৈতিক দলকেই দায়িত্বশীলতার প্রমাণ দিতে হবে। দেশে নতুন একটা রাজনৈতিক বন্দোবস্তের আয়োজন চলছে। সকল দলকেই সরকারের সঙ্গে আলোচনায় বসে ঐকমত্যে পৌঁছাতে হবে। তা না হলে অতীতের সংঘাতপূর্ণ রাজনীতির অবসান হবে না। দেশের একটি বৃহৎ জনগোষ্ঠীর সমর্থন আছে বিএনপির প্রতি। তারা দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিলে ভবিষ্যতে একটি সুন্দর রাষ্ট্র ব্যবস্থা জাতি পেতে পারে।

বিএনপি আশঙ্কা করছে, অন্তর্র্বতী সরকারের ক্ষমতা দীর্ঘায়িত হলে দেশের গণতন্ত্রের জন্য বড় সংকট সৃষ্টি হতে পারে। সময় নষ্ট হলে রাজনৈতিক সহিংসতা, অর্থনৈতিক অস্থিরতা এবং সামাজিক বিভাজন আরও বৃদ্ধি পাবে। অপরদিকে, অন্তর্র্বতী সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, তাড়াহুড়ো করে অসম্পূর্ণ নির্বাচন করলে ভোটারের অধিকার ক্ষুণ্ন হতে পারে এবং নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা কমে যেতে পারে। তাই সময় নিয়ে সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজন করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।বর্তমানে অন্তর্র্বতী সরকারের ওপর জনগণের আস্থা কিছুটা কমে গেছে। চট্টগ্রাম বন্দরের ব্যবস্থাপনা বিদেশিদের হাতে দেওয়ার সিদ্ধান্ত, রাখাইনে মানবিক করিডোর প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব, কাতারকে সামরিক সরঞ্জাম তৈরির কারখানা স্থাপনের আহ্বান এবং সেন্ট মার্টিন ইস্যুতে স্বচ্ছতার অভাব— এ ধরনের সিদ্ধান্তগুলো নিয়ে জনমনে অসন্তোষ ও প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। ফলে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেও মতপার্থক্য ও বিভাজন আরও প্রকট হয়েছে। বিশ্লেষকদের মতে, এসব বিতর্কিত সিদ্ধান্ত আগামী নির্বাচন এবং তার গ্রহণযোগ্যতার ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলতে পারে।

বাংলাদেশ এখন একটি গুরুত্বপূর্ণ ও সংকটপূর্ণ সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। এখানে দুইটি বিপরীতমুখী দাবি একসঙ্গে টিকে আছে— একদিকে দ্রুত নির্বাচন আয়োজনের দাবি, অন্যদিকে সময় নিয়ে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজনের তাগিদ। দেশের গণতন্ত্রের স্বার্থে দ্রুত নির্বাচন জরুরি বলে মনে করছে বিএনপি ও তাদের সমমনা দলগুলো। তাদের মতে, সময় বাড়ালে গণতন্ত্র হুমকির মুখে পড়বে।

অপরদিকে, অন্তর্র্বতীকালীন সরকার বলছে, তাড়াহুড়ো না করে একটি গ্রহণযোগ্য ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজন করাই এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। তাই তারা সময় চায়, যাতে নির্বাচনী ব্যবস্থা ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করা যায়। এই দুই পক্ষের যুক্তির মধ্যে ভারসাম্য আনা না গেলে রাজনৈতিক সংকট আরও ঘনীভূত হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বিশ্লেষকরা।বাংলাদেশ এখন এক গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে। একদিকে রয়েছে দ্রুত নির্বাচন আয়োজনের দাবি, যার পেছনে আছে গণতান্ত্রিক অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার আশা; আর অন্যদিকে রয়েছে সময় নিয়ে প্রয়োজনীয় সংস্কার সম্পন্ন করে একটি গ্রহণযোগ্য ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন আয়োজনের পরিকল্পনা। তবে এই দুই পথের মাঝে যদি কোনো সমঝোতায় পৌঁছানো না যায়, তাহলে পরিস্থিতি শুধু জটিলই হবে না— দেশ আরও একবার নতুন রাজনৈতিক অস্থিরতার দিকে ধাবিত হতে পারে।