মেঘনা পেট্রোলিয়াম লিমিটেডে উপ-মহাব্যবস্থাপক (ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার—ডিজিএম) পদে পদোন্নতি নিয়ে উঠেছে চাঞ্চল্যকর অভিযোগ। অভিযোগ রয়েছে, পদোন্নতির তালিকায় অন্তর্ভুক্ত অধিকাংশ কর্মকর্তা বিগত ফ্যাসিস্ট আওয়ামী সরকারের আমলে সুবিধাভোগী, দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত এবং প্রভাবশালী সিন্ডিকেটের সদস্য ছিলেন। বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে, তৎকালীন জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদকে ম্যানেজ করে মেঘনা পেট্রোলিয়ামের তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মীর ছাইফুল্লাহ আল খালেদের ছত্রছায়ায় কিছু কর্মকর্তা একটি শক্তিশালী দুর্নীতিবাজ সিন্ডিকেট গড়ে তোলেন। এই সিন্ডিকেট নিয়োগ, বদলি, পদোন্নতি, ডিলার নিয়োগ, ডিপো থেকে কোটি কোটি টাকা চাঁদা আদায়, লুব তেল আমদানির এলসি থেকে অর্থ আত্মসাৎ, এমনকি ব্যাংকের এফডিআর থেকেও টাকা হাতিয়ে নেওয়ার মতো নানা অনিয়মে জড়িত ছিল।
বর্তমানে এই সিন্ডিকেটের মূল হোতা হিসেবে পরিচিত হচ্ছেন কোম্পানির জেনারেল ম্যানেজার (এইচআর) ইনাম ইলাহী চৌধুরী এবং জেনারেল ম্যানেজার (মার্কেটিং) ও সাবেক কোম্পানি সচিব রেজা মো. রিয়াজ উদ্দিন, যিনি স্থানীয়ভাবে “উজ্জল” নামে পরিচিত ও আওয়ামী ঘনিষ্ঠ নেতা হিসেবে পরিচিত।
তৎকালীন শাসনামলে প্রভাব খাটিয়ে রেজা মো. রিয়াজ উদ্দিন একের পর এক সিনিয়র কর্মকর্তাকে ডিঙিয়ে অস্বাভাবিক গতিতে পদোন্নতি পান। তার বিরুদ্ধে প্রতি মাসে ভূয়া বিল তৈরি করে লক্ষাধিক টাকা আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে। জানা গেছে, তিনি চট্টগ্রামের একেখান এলাকায় একাধিক ফ্ল্যাট এবং দুই ভাইয়ের সঙ্গে যৌথভাবে পাহাড়তলী এলাকায় সাততলা বিশিষ্ট বিলাসবহুল ভবন নির্মাণ করেছেন।
অন্যদিকে, তার সহযোগী ইনাম ইলাহী চৌধুরী পার্চেস শাখায় দায়িত্ব পালনকালে অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছেন। চট্টগ্রামের চাঁদগাঁও আবাসিক এলাকায় তার পাঁচতলা ভবন রয়েছে বলে জানা গেছে। নিয়োগে অনিয়ম ও অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে শ্রমিক নিয়োগ পরীক্ষা বাতিল হলেও, প্রায় ৬৭ লাখ টাকা অনিয়মের ঘটনায় দায়ী এই কর্মকর্তা এখনো বহাল তবিয়তে আছেন।
সূত্র জানায়, ইনাম ইলাহী চৌধুরী ও রেজা মো. রিয়াজ উদ্দিনের প্রভাবেই ডিজিএম পদে পদোন্নতির তালিকায় এমন অনেক কর্মকর্তার নাম এসেছে, যাদের বিরুদ্ধে গুরুতর দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, পদোন্নতিতে সিনিয়রিটি, অভিজ্ঞতা বা মেধার বদলে মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
তালিকায় রয়েছেন মো. মুজিবুর রহমান চৌধুরী, যার বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলা দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) তদন্তাধীন। একইভাবে “তেলখেকো” খ্যাত মো. জালাল উদ্দিন, যিনি বাঘাবাড়ী ডিপোতে ইনচার্জ থাকাকালে প্রায় ১ লাখ ৭০ হাজার লিটার ডিজেল আত্মসাৎ করেন, তাকেও পদোন্নতির তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, তিনি ৩০ লাখ টাকার বিনিময়ে তৎকালীন এমডি মীর ছাইফুল্লাহ আল খালেদকে ম্যানেজ করে প্রধান কার্যালয়ে বদলি হন।
কোম্পানির অভ্যন্তরীণ সূত্র জানিয়েছে, এজিএম থেকে ডিজিএম পদে পদোন্নতির তালিকায় রয়েছেন ১১ জন কর্মকর্তা। চট্টগ্রাম হেড অফিসে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের এক উপসচিবের নেতৃত্বে অনুষ্ঠিত পদোন্নতি কমিটির বৈঠকে সাতজনকে চূড়ান্ত বিবেচনায় রাখা হয়। তাদের মধ্যে আছেন শোকজপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. হুমায়ুন কবির।
এ তালিকায় আরও আছেন সহকারী মহাব্যবস্থাপক (সেলস) ওমর ফারুক মিঞাজী—তৎকালীন এমডি মীর ছাইফুল্লাহ আল খালেদের ভাতিজা—এবং আহসানুল আমিন, যিনি সাবেক শেকৃবি ছাত্রলীগ নেতা ছিলেন। ডেপুটি ম্যানেজার (সেলস) পদে যোগ্যতা হিসেবে যেখানে ১২ বছরের অভিজ্ঞতা প্রয়োজন, সেখানে এই দুই কর্মকর্তার অভিজ্ঞতা ছিল মাত্র ৮ বছর। বর্তমানে তাদের চাকরির মেয়াদ ১২ বছর হলেও, তারা কোম্পানির ইতিহাসে সর্বকনিষ্ঠ ডিজিএম হতে যাচ্ছেন।
অভিযোগ রয়েছে, ডিজিএম পদে পদোন্নতির তালিকায় চারজন ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারও রয়েছেন, যা বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের ২০২৪ সালের নীতিমালার স্পষ্ট লঙ্ঘন। নীতিমালা অনুযায়ী, ১ম শ্রেণীর ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়াররা অন্তত পাঁচ বছর পর এজিএম হতে পারেন। কিন্তু এমডি মীর সাইফুল্লাহ আল খালেদ ও কোম্পানি সচিব রেজা মো. রিয়াজ উদ্দিনের “বিশেষ বিবেচনায়” মাত্র তিন বছরেই তারা এজিএম হন।
জনপ্রশাসন বিধি অনুযায়ী, অভিযোগ বা গোপনীয় প্রতিবেদন (এএসিআর)-এ বিরূপ মন্তব্য থাকলে পদোন্নতি দেওয়া যায় না। তবুও অসদ আচরণের দায়ে অভিযুক্ত সহকারী মহাব্যবস্থাপক (পি অ্যান্ড ই) হুমায়ুন কবিরকে অর্থের বিনিময়ে পদোন্নতির প্রস্তুতি চলছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
এ বছর অবসরে যাচ্ছেন জেনারেল ম্যানেজার (এইচআর) ইনাম ইলাহী চৌধুরী। অভিযোগ রয়েছে, অবসরের আগে কোটি টাকার বিনিময়ে তিনি “ডিপ্লোমা সিন্ডিকেট” সদস্যদের পদোন্নতি নিশ্চিত করেছেন।
এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে ইনাম ইলাহী চৌধুরী বলেন, “পদোন্নতি কমিটির বাইরে আমরা কোনো মন্তব্য করতে পারব না।”
অন্যদিকে, বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. শাহীরুল হাসান বলেন, “বোর্ডের নির্দিষ্ট সদস্যরা কর্মকর্তাদের যোগ্যতা বিবেচনা করেই পদোন্নতি দেবেন।”
বাঘাবাড়ি ডিপোর অভিযুক্ত সাবেক ইনচার্জ মো. জালাল উদ্দিন ও হুমায়ুন কবিরের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তারা ফোন রিসিভ করেননি এবং বার্তারও জবাব দেননি।
তালিকায় আরও রয়েছেন সাবেক মহাব্যবস্থাপক (অপারেশনস ইঞ্জিনিয়ার) মফিজুর রহমানের আশীর্বাদপুষ্ট দুই কর্মকর্তা—সহকারী মহাব্যবস্থাপক মো. আবুল মেরাজ ও শফিকুর রহমান তালুকদার। তারা দাবি করছেন, পদোন্নতি নীতিমালা ২০২৪ অনুযায়ী শুধুমাত্র জ্যেষ্ঠতা পদোন্নতির একমাত্র মানদণ্ড নয়। তবে তাদের এএসিআর নম্বর কম হওয়ায় পদোন্নতি থেকে বাদ পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
পরিচালনা পর্ষদের নির্দেশনা অনুযায়ী, ২০২৫ সালের পদোন্নতিতে ২০২৩ ও ২০২৪ সালের এএসিআর অন্তর্ভুক্ত করার কথা থাকলেও, ইনাম ইলাহী চৌধুরী ও রেজা মো. রিয়াজ উদ্দিন নিজেদের ঘনিষ্ঠ কর্মকর্তাদের অতিমূল্যায়ন করে উচ্চ নম্বর প্রদান করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
অভিযোগ গ্রহণ করেও ইনাম ইলাহী চৌধুরী তা বোর্ডে উপস্থাপন করেননি। ফলে যোগ্য ও জ্যেষ্ঠ প্রায় ৪০-৫০ জন কর্মকর্তা পদোন্নতি থেকে বঞ্চিত হয়ে মারাত্মক হতাশায় ভুগছেন।