পুরোনো বইয়ের দোকানের দরজার খটখটে শব্দে ভোরের প্রথম ধ্বনি ভেসে আসে। গলির শেষ প্রান্তে, যেখানে আরেকটি দোকানের ঝুলন্ত রশি বাতাসে নাচছে, সেখানে নীলা প্রবেশ করে। তার হাতে ছোট্ট ব্যাগ, চোখে এক অদ্ভুত উজ্জ্বলতা—যেমন সে কোনো অজানা রহস্যের সন্ধানে এসেছে।
দোকানের ভেতরে ঢোকার সাথে সাথেই বইয়ের গন্ধ তাকে আলিঙ্গন করে। মাটি, ধুলো, এবং কাগজের মৃদু সান্নিধ্য—সব মিলিয়ে এমন এক শান্তি, যা শব্দে প্রকাশ করা যায় না। নীলা ধীরে ধীরে তাকাল। প্রতিটি তাক যেন নিঃশব্দে বলছে—“এইখানেই তুমি যা খুঁজছো, পাবে।” চোখে পড়ে একটি সাদা কাগজের কভার, যেখানে লেখা: রবীন্দ্রনাথের “শেষের কবিতা”।
সেই মুহূর্তে তার দৃষ্টি আরেকজনের দিকে যায়। রবি, একই বইয়ের সামনে দাঁড়িয়ে, চোখে এক অদ্ভুত শান্তি এবং ঘূর্ণিঝড়ের মতো আগ্রহ। তার দেহভঙ্গি নিখুঁতভাবে স্থির, কিন্তু চোখ—চোখে যেন কাব্যিক শব্দগুলো বাজছে।
দোকানদার শান্ত কণ্ঠে বলল,
—“একটাই কপি আছে। আপনারা চাইলে ভাগাভাগি করতে পারেন।”
নীলা মুহূর্তের জন্য স্থবির হয়ে যায়। তারপর হেসে ওঠে—একটা নীরব, কোমল হাসি, যা সরাসরি রবির দিকে ছোঁয়া দেয়। রবি ধীরে ধীরে হেসে বলল,
—“আমি আগে পড়েছি, ও নিক।”
কোনো কথার লড়াই নেই। কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতা নেই। শুধু চোখে চোখের সেই প্রথম সংযোগ। দু’জনেই অনুভব করে, তারা একে অপরকে বাধ্য করছে না, কেউ এগোচ্ছে না—তবু এক অদৃশ্য সেতু গড়ে উঠছে।
নীলা বইটি হাতে ধরে কৌতূহলভরে তাকাল। তার চোখে রবি যেন পুরো গল্পটাই পড়ছে—কিন্তু শব্দে নয়, অনুভূতিতে। রবি ধীরে ধীরে বলল,
—“ভালো বই কখনো ধীরে পড়া উচিত। দ্রুত পড়লে তার স্বাদ আসে না।”
নীলা মৃদু হাসি দিয়ে বলল,
—“হ্যাঁ, সত্যি। শব্দের মতো কিছুই হুট করে বোঝা যায় না।”
এ কথায় যেন নিঃশব্দে মিলনের প্রথম ছোঁয়া গেল। শব্দে নয়, বুঝবার চোখে। একটি অদৃশ্য বন্ধন তৈরি হলো, যা এখনও তাদের স্পর্শে আসেনি।
বাইরে বিকেলের আলো ঢুকে পড়ছে। দোকানের ধুলোয় আলো নাচছে। নীলা বইটি হাতে ধরে, রবি পাশে দাঁড়িয়ে, দু’জনেই এক অদ্ভুত শান্তি অনুভব করছে। তারা একে অপরকে ডাকছে না, কেউ এগোচ্ছে না। তবু হৃদয় একে অপরের দিকে টানে—একটা সূক্ষ্ম, অদৃশ্য, অব্যক্ত টান।
দোকান থেকে বের হওয়ার সময় নীলা হঠাৎ রুবির দিকে তাকাল।
—“তোমার নাম?”
—“রবি,” সে হেসে উত্তর দিল।
সেই হেসে উত্তর—একটি ছোট্ট শব্দ, যা এক নবীন বন্ধুত্বের সূচনা, এক নীরব প্রতিজ্ঞা।
দূরত্ব, যা পরবর্তীতে তাদের ভালোবাসার মূল ভাষা হয়ে উঠবে, সেই দূরত্ব প্রথমবার তাদের মধ্য দিয়ে ঢুকেছিল। তারা দু’জনই জানত—এই মিলন কখনো কাছাকাছি স্পর্শে নয়, শব্দে নয়।
দোকানের বাইরে বাতাসে হালকা শীতল ছোঁয়া। তারা আলাদা আলাদা রাস্তায় চলে গেল। কিন্তু চোখে চোখের সেই সংযোগ—ছোঁয়া না দিয়ে স্পর্শ—অমর হয়ে রইল।
রাস্তায় হঠাৎ নীলা থামল। সে মনে মনে ভাবল, “এই মানুষটিকে আমি জানি না, কিন্তু তার উপস্থিতি যেন আমার রক্তে মিশে গেছে।” রবি একই সময়ে কিছুটা দূরে থেমে দাঁড়াল। তারা একে অপরকে স্পর্শ না করলেও, হৃদয় তাদের মধ্যে চলতে লাগল নিঃশব্দে।
নীলার মাথায় ঘুরছে সেই প্রথম বইয়ের দোকানের ছবি। ধুলো, আলো, এবং বইয়ের গন্ধ—সব মিলিয়ে যেন এক অদ্ভুত মায়াবী দৃশ্য। রবি কেমন করে এত দ্রুত তার চোখে স্থির হয়ে গেল—এটি নীলা বুঝতে পারছে না। কিন্তু এক জিনিস নিশ্চিত—এই প্রথম দেখা, এই অদৃশ্য সংযোগ, কোনো সাধারণ দিনের অংশ নয়।
রবিরও অনুভূতি অদ্ভুত। সে জানে, এই প্রথম মুহূর্তটাই এক ধরনের শান্তির বার্তা দিয়েছে। কোনো তাড়াহুড়ো নেই, কোনো দাবী নেই। শুধু দেখা, অনুভব, এবং নীরব স্বীকৃতি।
দু’জনেই জানে—ভালোবাসা কখনো চাপে জন্মায় না। ভালোবাসা ছোঁয়ার আগে, চোখে চোখে, অন্তরে অন্তরে, অদৃশ্য দূরত্বে প্রথমে জন্ম নেয়।
নিশ্চিতভাবে, তারা এই মুহূর্তে একে অপরের জীবনের অংশ হয়ে গেছে, যদিও স্পর্শ হয়নি। এই নীরব সংযোগই হবে তাদের ভবিষ্যতের মেলবন্ধনের ভিত্তি।
দু’জন আলাদা আলাদা পথে হেঁটে চলে গেল, কিন্তু মন একে অপরের দিকে টানে। চোখে চোখের সেই নীরব স্পর্শ—একটি ছোঁয়া নয়, বরং অনুভূতির গভীর আবহ।
বাতাসের হালকা ঠাণ্ডা স্পর্শ, বিকেলের নরম আলো, এবং ধুলোয় আলো নাচ—সবই যেন তাদের গল্পের প্রথম পৃষ্ঠা লিখে দিচ্ছে। এই প্রথম দেখা ছিল শুধু দেখা নয়, এটা ছিল দূরত্বের মধ্যে জন্ম নেওয়া নিঃশব্দ ভালোবাসা, যা কখনো শব্দে প্রকাশ হবে না, কখনো স্পর্শে মিশবে না, কিন্তু হৃদয়ে চিরকাল অমর হয়ে থাকবে।