ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১ জানুয়ারী ২০২৬,
সময়: ০৫:১৭:০৫ AM

এক যুগের অবসান:বেগম খালেদা জিয়া

মান্নান মারুফ
31-12-2025 07:46:19 PM
এক যুগের অবসান:বেগম খালেদা জিয়া

জাতির রাজনৈতিক ইতিহাসে এক গভীর শূন্যতা সৃষ্টি করে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)-এর চেয়ারপারসন ও তিনবারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার ইন্তেকালে দেশজুড়ে নেমে আসে শোকের ছায়া। দীর্ঘ পাঁচ দশকের বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের অবসান ঘটিয়ে তিনি ইতিহাসের পাতায় এক অবিচ্ছেদ্য অধ্যায় হয়ে থাকলেন। এদিকে শোক বইয়ে স্বাক্ষর করেন,ঢাকায় নিযুক্ত ব্রিটিশ হাইকমিশনার ,সারাহ কুক,স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা 
মেজর জেনারেল অবঃ জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী,ডেনমার্ক রাষ্ট্রদুত, জাপান রাষ্ট্রদুত,সৌদি আরব, রাশিয়া, মায়ানমার, মালয়েশিয়া, জাতিসংঘ ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ইউএনডিপি, সহ ১৫ টি দেশের প্রতিনিধি এখন পর্যন্ত স্বাক্ষর করেন । খালেদা জিয়ার মৃত্যুর পর রাজধানী থেকে প্রান্তিক জনপদ—সবখানেই মানুষের মুখে মুখে উচ্চারিত হয়েছে একটাই কথা: একটি যুগের অবসান

জানাজায় মানুষের ঢল

লাখো মানুষের চোখের জল ও শ্রদ্ধা—মানবতার এক অভূতপূর্ব মিলন । রাজধানীর জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় অনুষ্ঠিত জানাজায় লাখো মানুষের ঢল নামে। জাতীয় মসজিদের খতিবের ইমামতিতে অনুষ্ঠিত এ জানাজায় অংশ নিতে মহাখালী, বাংলামোটর, মিরপুর সড়ক, কলাবাগান ও আসাদগেট পর্যন্ত জনস্রোত ছড়িয়ে পড়ে। রাজনীতিক, কূটনীতিক, পেশাজীবী, শ্রমজীবী—সব শ্রেণি-পেশার মানুষ এক কাতারে দাঁড়িয়ে শেষ বিদায় জানান। রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় অনুষ্ঠিত এই জানাজা পরিণত হয় এক নীরব গণসমাবেশে, যেখানে শোক আর স্মৃতির ভারে স্তব্ধ হয়ে পড়ে পুরো এলাকা।

সমাধিস্থল ও শেষ বিদায়

পরিবারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তাকে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের কবরের পাশে সমাহিত করা হয়। দাফনের মুহূর্তে আবেগ সংবরণ করতে পারেননি বহু মানুষ। রাজনৈতিক মতভেদ ভুলে, ইতিহাসের এক দীর্ঘ অধ্যায়ের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে জাতি যেন একত্র হয়েছিল।


জন্ম ও পারিবারিক শেকড়

বেগম খালেদা জিয়া জন্মগ্রহণ করেন ১৯৪৬ সালের ১৫ আগস্ট দিনাজপুর জেলায়। বাবা ইস্কান্দার মজুমদার ও মা তৈয়বা মজুমদারের সুশৃঙ্খল পারিবারিক পরিবেশে তার বেড়ে ওঠা। শৈশব থেকেই তিনি ছিলেন আত্মমর্যাদাশীল ও দৃঢ়চেতা—যার প্রতিফলন পরবর্তীকালে তার রাজনৈতিক জীবনে স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

শিক্ষা ও শৈশব

দিনাজপুর সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা শেষ করে তিনি ঢাকার সুরেন্দ্রনাথ কলেজে অধ্যয়ন করেন। রাজনীতির আলো তখনও তার জীবনে প্রবেশ করেনি; তবে শৃঙ্খলা, সংযম ও আত্মবিশ্বাস—এই গুণগুলো তাকে ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত করছিল নীরবে।

জিয়াউর রহমানের সঙ্গে বিবাহ

১৯৬০ সালে তৎকালীন সেনা কর্মকর্তা জিয়াউর রহমানের সঙ্গে তার বিবাহ হয়। এই দাম্পত্য সম্পর্কই পরবর্তীকালে তাকে রাষ্ট্রীয় ও রাজনৈতিক জীবনের কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে আসে। স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশের টালমাটাল সময়ে একজন সেনা কর্মকর্তার স্ত্রী হিসেবে তিনি নীরব সমর্থক ও পর্যবেক্ষকের ভূমিকা পালন করেন।

শোক থেকে শক্তিতে রূপান্তর

১৯৮১ সালে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের শাহাদাত বরণ বেগম খালেদা জিয়ার জীবনের গতিপথ আমূল বদলে দেয়। ব্যক্তিগত শোককে শক্তিতে রূপান্তর করে তিনি এগিয়ে আসেন রাজনীতির কঠিন ময়দানে। এই রূপান্তর ছিল ইতিহাসনির্ধারক।

রাজনীতিতে আনুষ্ঠানিক পদার্পণ

১৯৮২ সালে তিনি বিএনপির সাধারণ সদস্য হিসেবে রাজনীতিতে যোগ দেন। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই তার নেতৃত্বগুণ ও সাংগঠনিক দক্ষতা দলকে নতুন করে উজ্জীবিত করে তোলে।

বিএনপির চেয়ারপারসন

১৯৮৪ সালে তিনি বিএনপির চেয়ারপারসন নির্বাচিত হন। পুরুষতান্ত্রিক রাজনৈতিক বাস্তবতায় একজন নারীর এই নেতৃত্ব গ্রহণ ছিল সাহসী ও যুগান্তকারী।

এরশাদবিরোধী আন্দোলন

সামরিক শাসক হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের বিরুদ্ধে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আন্দোলনে তিনি নেতৃত্ব দেন। সাতদলীয় জোট গঠনে তার ভূমিকা ছিল ঐতিহাসিক, যা শেষ পর্যন্ত স্বৈরাচার পতনের পথ প্রশস্ত করে।

‘আপোষহীন নেত্রী’

বারবার গ্রেপ্তার, নির্যাতন ও রাজনৈতিক চাপের মুখেও আপস না করায় তিনি পরিচিতি পান ‘আপোষহীন নেত্রী’ হিসেবে। এই উপাধি তাকে যেমন জনপ্রিয় করেছে, তেমনি করেছে বিতর্কিতও।

ছাত্ররাজনীতি ও গণআন্দোলন

জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলকে সংগঠিত করে তিনি গণআন্দোলনে নতুন গতি সঞ্চার করেন। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে ছাত্রসমাজের ভূমিকা ছিল निर्णায়ক।

প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী

১৯৯১ সালের নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে তিনি বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হন। তার নেতৃত্বে সংসদীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়, যা দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক মাইলফলক।

প্রথম মেয়াদের অর্জন

প্রথম মেয়াদে অর্থনীতি, কর্মসংস্থান ও তৈরি পোশাক শিল্পে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধিত হয়। গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো পুনর্গঠনে তার সরকারের ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ।

আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ভূমিকা

জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক মঞ্চে তিনি গঙ্গার পানি বণ্টন ও রোহিঙ্গা সংকটসহ বিভিন্ন ইস্যুতে বাংলাদেশের পক্ষে দৃঢ় কণ্ঠে কথা বলেন।

পদত্যাগ ও বিরোধী রাজনীতি

১৯৯৬ সালে রাজনৈতিক সংকট নিরসনে তিনি প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে সরে দাঁড়িয়ে বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। এরপর বিরোধী রাজনীতিতে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন।

চারদলীয় জোট ও পুনরাগমন

২০০১ সালের নির্বাচনে চারদলীয় জোটের নেতৃত্ব দিয়ে তিনি তৃতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী হন। এই মেয়াদ ছিল তার রাজনৈতিক জীবনের অন্যতম আলোচিত অধ্যায়।

নারী শিক্ষা ও ক্ষমতায়ন

নারী শিক্ষা, উপবৃত্তি ও সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে তার অবদান আন্তর্জাতিকভাবেও স্বীকৃত হয়।

ক্ষমতা হস্তান্তর ও কারাবাস

২০০৬ সালে শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের পর তিনি রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হয়ে কারাবরণ করেন—এমন অভিযোগ তার দলের পক্ষ থেকে দীর্ঘদিন উচ্চারিত হয়েছে।

অসুস্থতা ও চিকিৎসা সংগ্রাম

কারাবাসে তার শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটে। দীর্ঘদিন চিকিৎসার জন্য বিদেশ যাওয়ার অনুমতি না পাওয়া ছিল তার জীবনের এক করুণ অধ্যায়।

অপরাজেয় নির্বাচনী রেকর্ড

জাতীয় সংসদ নির্বাচনে একাধিক আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে কখনো পরাজিত না হওয়া তার রাজনৈতিক জীবনের এক অনন্য কীর্তি।

চিরবিদায় ও ইতিহাসে স্থান

বেগম খালেদা জিয়া (কাল্পনিকভাবে) চিরবিদায় নিলেও তার রাজনৈতিক উত্তরাধিকার, সংগ্রাম ও বিতর্ক বাংলাদেশের ইতিহাসে দীর্ঘদিন আলোচিত থাকবে। সমর্থক ও সমালোচক—উভয়ের কাছেই তিনি এক অনিবার্য রাজনৈতিক চরিত্র। তার জীবনের সঙ্গে মিশে আছে বাংলাদেশের গণতন্ত্রের উত্থান-পতনের ইতিহাস।